সংগৃহীত
বাণিজ্য

মাছের ‘ফেলনা’ আঁশ যাচ্ছে বিদেশে

কুমিল্লা প্রতিনিধি

মাছের আঁশকে সচরাচর আমরা ফেলেই দিই। কিন্তু এই আঁশ বিদেশে রপ্তানি করা যায়। আয় করা যায় বৈদেশিক মুদ্রাও। এমনটিই হচ্ছে কুমিল্লায়।

গোমতী নদীর বেড়িবাঁধ সড়ক ধরে কুমিল্লা নগর থেকে বিবির বাজারের দিকে যেতেই চোখে পড়বে ভিন্ন রকম এক কর্মযজ্ঞ। বেড়িবাঁধ সড়কের পাশে ত্রিপল বিছিয়ে শুকানো হয় মাছের আঁশ।

মাছের আঁশ শুকানোর কাজ করে মো. মাহাবুব আলমসহ কয়েকজন যুবকের জীবনের গল্প বদলে গেছে। মাহাবুব কুমিল্লা নগরের সংরাইশ এলাকার ইয়াকুব আলীর ছেলে। তিনি কুমিল্লা নগরের অন্যতম প্রধান কাঁচাবাজার রাজগঞ্জ বাজারে দুই যুগের বেশি সময় ধরে মাছ কাটার কাজ করেছেন। শুরুর দিকে মাছ কেটে দিয়ে যা আয় হতো, তা দিয়েই কোনোরকমে চলছিল তার সংসার। দিনভর মাছ কাটার পর আঁশগুলো ফেলে দিতেন বাজারের পাশের ডাস্টবিনে। হঠাৎ একদিন এই ফেলনা আঁশগুলোই ভাগ্য বদলে দিতে শুরু করে তার।

মাহাবুব বললেন, প্রায় ১৩ বছর আগের ঘটনা। রাজগঞ্জ বাজারে মাছ কাটার কাজ করছিলাম। মাছ কাটার মধ্যেই ঢাকা থেকে আসা এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয় আমার। কথার ফাঁকেই ওই ব্যবসায়ী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, মাছ কাটার পর আঁশগুলো কী করেন? তখন আমি বলি, ডাস্টবিনে ফেলে দিই। ওই ব্যবসায়ী বললেন, আঁশগুলো যদি আমাকে শুকিয়ে দেন, তাহলে আমি আপনাকে ভালো টাকা দেব।

এমন কথা শুনে অবাক হন মাহাবুব। ওই ব্যবসায়ীর কথামতো আঁশগুলো পরিষ্কার করে শুকিয়ে প্রথম দিন মাছের ১০ কেজি শুকনা আঁশ দেন। ওই ব্যবসায়ী তাকে ৪০০ টাকা দেন। এতে তার আস্থা ও উৎসাহ বেড়ে যায়। বর্তমানে রাজগঞ্জ বাজারে তার মাছ কাটার দোকান আছে। সেখানে কয়েকজন মাছ কাটেন ও মাছের আশ শুকান, আর তিনি সব কাজ তদারক করেন। এখন প্রতি কেজি মাছের শুকনা আঁশ বিক্রি করছেন ৭০ টাকায়। কুমিল্লার এই মাছের আঁশ রপ্তানি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। পাইকারদের কাছ থেকে মাহাবুব জানতে পেরেছেন, মাছের আঁশগুলো চীনসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। সেখান থেকে এগুলো জাপানসহ বিভিন্ন দেশে চলে যায়।

সম্প্রতি কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার অরণ্যপুর ও ঝাকুনিপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শুধু সড়কের পাশেই নয়, গোমতীর চরের ভেতরে কয়েকটি স্থানে শুকানো হচ্ছে মাছের আঁশ। আঁশ শুকানোর কাজে জড়িত এক তরুণ জানান, আঁশ শুকানো ছাড়াও মাছের উচ্ছিষ্ট অংশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে একধরনের তেল। মাছ ও মুরগির খাদ্য তৈরির উপাদান সেখান থেকে তৈরি হচ্ছে। মূলত মাছ কাটার পর আঁশ, নাড়িভুঁড়িসহ উচ্ছিষ্ট অংশ দিয়েই তৈরি হচ্ছে তেল ও মাছ-মুরগির খাদ্য তৈরির উপাদান।

মাহাবুবের দেখাদেখি অনেকেই এখন মাছের আঁশ শুকানোর কাজ করছেন। মাহাবুব বলেন, বছরখানেক আগে তিনিসহ কয়েকজন মিলে এই কাজ শুরু করেন। আঁশ ছাড়া বাকি উচ্ছিষ্ট অংশগুলো জ্বালিয়ে তেল বের করা হয়। বাকি অংশ মাছ-মুরগির খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ওই তেলও মাছ-মুরগির খাদ্য তৈরির সময় মিশ্রণ করা হয়। এতে সুন্দর একটি ঘ্রাণ আসে। কক্সবাজারের মাছ-মুরগির খাদ্য তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁদের কাছ থেকে তেল সংগ্রহ করে থাকে।

মাহাবুব বলেন, ‘কুমিল্লায় মাছের আঁশ শুকানোর কাজটা আমিই শুরু করেছিলাম। তবে বর্তমানে প্রায় ১০ জন এই ব্যবসা করছেন। এ কারণে বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। আমরা বিভিন্ন বাজার থেকে মাছের আঁশসহ উচ্ছিষ্ট অংশ সংগ্রহ করি। এগুলো সংগ্রহ করতে প্রথম দিকে সামান্য টাকা দিতে হতো। এখন প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। যারা মাছ কাটেন তাদেরও ভালো অঙ্কের টাকা দিতে হয়। আমরা মাসে গড়ে ৬০০ থেকে এক হাজার কেজি মাছের আঁশ শুকিয়ে বিক্রির উপযোগী করতে পারি। আঁশগুলো শুকানোর পর বস্তায় ভরে গুদামে রেখে দিই। মাস শেষে ঢাকা থেকে আসা পাইকারেরা ট্রাকে করে এসব নিয়ে যান। আগে লাভ অনেক বেশি হতো, তবে এখন অনেকে এ কাজে যুক্ত হওয়ায় ব্যবসা কমে গেছে। এরপরও সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে এখনো ভালো একটা আয় হচ্ছে।’

অরণ্যপুর ও ঝাকুনিপাড়া এলাকায় মাছের আঁশ শুকানোর কাজে নিয়োজিত আছেন সালাউদ্দিনসহ অন্তত সাত যুবক। তাদের মাসিক বেতন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে। থাকা-খাওয়া তাদের মালিকের।

মাসে ১২ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছেন জানিয়ে সালাউদ্দিন বলেন, বাজারে যারা মাছ কাটেন, তারা বস্তায় আঁশসহ উচ্ছিষ্ট অংশগুলো রেখে দেন। এরপর বিকালে গিয়ে এগুলো তারা নিয়ে আসেন। এসব পরিষ্কার করে আঁশগুলো পরদিন সকালে শুকানো হয়। আর বাকি অংশগুলো চলে যায় তেল তৈরিসহ মাছ-মুরগির খাদ্য তৈরির কাজে।

এ কাজে যুক্ত অন্যরা জানান, নগরের রাজগঞ্জ, টমছমব্রিজ, চোয়ারা, বাদশা মিয়ার বাজার, পদুয়ার বাজার, রানীর বাজার, কুমিল্লা আদর্শ সদরের কালির বাজারসহ আশপাশের বিভিন্ন বাজার থেকে মাছের আঁশসহ উচ্ছিষ্ট অংশ সংগ্রহ করা হয়। প্রতিদিন সকালে রোদে দিলে দুপুরের মধ্যেই আঁশ শুকিয়ে যায়। মাছের নাড়িভুঁড়ি, পাখনা, লেজের অংশ, কানের অংশসহ উচ্ছিষ্ট অংশ থেকে তেল তৈরি হয়। ওষুধ, প্রসাধনসামগ্রী, ফুড সাপ্লিমেন্ট ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয় মাছের আঁশ। বাংলাদেশ থেকে চীন ও ইন্দোনেশিয়া হয়ে এসব আঁশ যাচ্ছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ কয়েকটি দেশে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বেলাল হোসেন বলেন, কুমিল্লায় যারা মাছের আঁশ পরিষ্কার করে শুকানোর সঙ্গে যুক্ত, তাদের সুনির্দিষ্ট তালিকা নেই। তবে এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। বিশেষ করে চীনে এই আঁশগুলো বেশি রপ্তানি হচ্ছে। এতে ফেলনা জিনিস থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে দেশে। যারা এই কাজে যুক্ত, তারা সহায়তা চাইলে অবশ্যই সহায়তা করা হবে। আর উচ্ছিষ্ট অংশ থেকে তেল ও মাছ-মুরগির খাদ্যের উপাদান তৈরিও ভালো একটি উদ্যোগ।

আমারবাঙলা/এমআরইউ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

বিটিভির ‘প্যাকেজ প্রিভিউ কমিটি’তে সাংবাদিক আহমেদ তেপান্তর

বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘প্যাকেজ প্রিভিউ কমিটি&r...

গজারিয়া উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উচ্ছেদ অভিযান

পরিবেশ সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি গজার...

কামড়ে মিলবে সোনার ছোঁয়া, বিশ্বের দামি বার্গার হতে চলেছে এটি

ছোট একটি বার্গার, যার দাম প্রায় পাঁচ লাখ টাকা! অব...

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ত্রিমুখী সংঘর্ষে নারী-শিশুসহ নিহত ৩

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে ট্রাক, মাইক্রোবাস ও পিকআপ...

‘পুঁতে ফেলব, কেউ জানতে পারবে না’

সিরিয়ায় বাশার আর-আসাদের পতন হয়েছে। তার দুই যুগের শ...

বিসিএস পরীক্ষায় বয়স সর্বোচ্চ ৩২ করে বিধি সংশোধন

সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণে...

মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ পড়ছেন যারা

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেছেন, বীর...

জনগণের আস্থা অর্জন করে একটি উন্নত দেশ গঠন করতে হবে

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষ...

গজারিয়া উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উচ্ছেদ অভিযান

পরিবেশ সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি গজার...

সব জিনিসের দাম একসঙ্গে কমানো সম্ভব না: অর্থ উপদেষ্টা

বাজার স্থিতিশীল আছে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি ব...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা