বাণিজ্য
চাঁদাবাজি রোধ ও সিন্ডিকেট ভাঙার দাবি ক্রেতাদের

নিম্নমুখী সবজির দাম, বাড়তি পেঁয়াজ-চাল-মাছের বাজার

নিজস্ব প্রতিবেদক

শীতকাল আসার আগেই বাজারে সবজির সরবরাহ বেড়েছে। ফলে দামও কমতে শুরু করেছে। তবে পুরোপুরি স্বস্তি আসেনি। এখনো বাজারে ৮০ টাকার ঘরেই বেশিরভাগ সবজির দাম ওঠানামা করছে। অন্যদিকে আগের মতো বাড়তি দাম রয়ে গেছে মাছের বাজারে। দীর্ঘদিন ধরে সব ধরনের মাছই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। একইসঙ্গে বেড়েছে আলু, পেঁয়াজ ও চালের দাম।

শুক্রবার (১ নভেম্বর) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। ক্রেতারা বলছেন, চাঁদাবাজি রোধ ও সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। আর খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, কেনা দাম বেশি পড়ায় তারা বেশি দামেই বিক্রি করেন। বাড়তি দামের জন্য সরবরাহ কমের অজুহাতও রয়েছে বিক্রেতাদের। যদিও ভোক্তাদের অভিযোগ কার্যকর তদারকি অভাবে অতি মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা।

দেখা যায়, ছোট সাইজের ফুলকপি প্রতি পিস ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, বাঁধাকপিও প্রতি পিস ৫০ টাকা। এ ছাড়া লম্বা বেগুন প্রতি কেজি ৬০ টাকা, ঝিঙা ৬০ টাকা, করোলা ৮০ টাকা, বরবটি প্রতি কেজি ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বাজারে সবচেয়ে বেশি দামি সবজির তালিকায় রয়েছে শিম, গাজর আর টমেটো। গাজর প্রতি কেজি ১৮০ টাকা, শিম প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়, টমেটো ১৬০ টাকা। গোল বেগুন, কাঁকরোলের কেজিও ১০০ টাকার ঘরে।
এ ছাড়া চিচিঙ্গা প্রতি কেজি ৬০ টাকা, কচুর লতির কেজি ৮০ টাকা, পটল ৬০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া প্রতি কেজি ৭০ টাকা, কাঁচা মরিচ ১৬০ টাকা, পেঁপে প্রতি কেজি ৪০ টাকা, মুলা ৬০ টাকা, ধুন্দুল ৬০ টাকা, কচুর মুখি ৬০ টাকা, লাউ প্রতি পিস ৫০ টাকা, শসা প্রতি কেজি ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

অন্যদিকে বাজারে সব ধরনের মাছের দামই বাড়তি যাচ্ছে। প্রতি কেজি পাঙাশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়, কাতল ৩২০ থেকে ৩৮০ টাকা, চাষের কই ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা, তেলাপিয়া ২৫০ টাকা, শিং মাছ ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা, গলসা কেজি ৬০০ টাকা, ট্যাংরা প্রতি কেজি ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া পাবদা প্রতি কেজি ৪০০ টাকা, রুই ৩৬০ টাকা, সরপুঁটি ৩০০ টাকা, রূপচাঁদা ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা, চিংড়ি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা, বোয়াল প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি পেঁয়াজে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা কেজি দরে। খুচরা বাজারে তা ১৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

চড়া আলুর দামও। প্রতি কেজি আলু কিনতে হচ্ছে ৬৫ টাকায়। গত সপ্তাহে যা ছিল ৬০ টাকা। বাড়তি দামের জন্য সরবরাহ কমের অজুহাত বিক্রেতাদের। যদিও ভোক্তাদের অভিযোগ কার্যকর তদারকি অভাবে অতি মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা।

এদিকে, শুল্ক কমানোর সুপারিশ করা হলেও কমেনি চালের দাম। ৫৪ টাকার নিচে মিলছে না মোটা চাল। সরু চালের কেজি ৭০ টাকার ওপরে। চাল বিক্রেতারা জানান, কোম্পানিগুলো বস্তাপ্রতি চাল বেশি দামে নির্ধারণ করে দিয়েছিল সপ্তাহ দুয়েক আগে। এই দাম আপাতত আর কমবে না। মাসখানেক পর আমনের নতুন ধান উঠার আগ পর্যন্ত দাম কমার সম্ভাবনা নেই।

ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকায়। ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৯০ টাকা। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিম ও চালের পাশাপাশি সয়াবিন তেল, পাম তেল, মসুর ডাল, রসুন ও দারুচিনি বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। এদিন খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন ১৫৮ টাকা, যা সাতদিন আগে ১৫৫ টাকা ছিল। প্রতি লিটার পাম তেল সুপার বিক্রি হচ্ছে ১৫১-১৫৪ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৫০-১৫৩ টাকা। মাঝারি দানার প্রতি কেজি মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা, সাতদিন আগে খুচরা পর্যায়ে এ ডাল বিক্রি হয়েছে ১১৫ টাকা।

বাজারে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৩০ থেকে ৭৫০ টাকা কেজি দরে, আর খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ১০০ টাকা কেজিতে।

মালিবাগ বাজারের ক্রেতা বেসরকারি চাকরিজীবী খাদেমুল ইসলাম বলেন, সবাই বলে সবজির দাম কমেছে কিন্তু বাজারে এসে দেখি সবগুলোর দামই বাড়তি। তবে দুই তিন সপ্তাহ আগে ১২০ টাকার ঘরে যেসব সবজি ছিল সেগুলো ১০০ টাকায় নেমেছে। কিন্তু এত দামেও কি সবজি কেনা সম্ভব? দাম কমেছে দেখা যায় শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিন্তু বাজারে আসলে চিত্র উল্টো।

শান্তিনগর এলাকার সবজি বিক্রেতা সোহেল আহমেদ বলেন, দুই তিন সপ্তাহ আগে সবজির দাম আরো বাড়তি ছিল। কিছুদিন হলো সেসবের দাম কিছুটা কমেছে। আসলে অনেক সবজির মৌসুম এখন শেষের দিকে, শীত পড়লে নতুন সবজি উঠবে তখন দাম কমে আসবে।

তেজকুনিপাড়ায় মুদি দোকানি খোরশেদ আলম বলেন, পেঁয়াজের দাম আরো বাড়ছে। এখন পেঁয়াজের বেশ সংকট শুনতেছি।

কারওয়ানবাজারের বাদশা রাইস এজেন্সির বিক্রেতা নূর হোসেন বলেন, এখন ৬০ টাকার নিচে কোনো চাল নেই বাজারে। দাম আপাতত কমবে মনে হয় না।

একই বাজারের দান রাইস এজেন্সির মালিক দিদার হোসেন বলেন, বাজারে চালের সংকট আছে, তা বলা যাবে না। মিলাররা মিল পর্যায়ে দাম বাড়ানোয় পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম বেড়েছে। মিলারদের কাছে চাল থাকলেও তারা বলছে নেই। আর অল্প পরিমাণে সরবরাহ করছে। তিনি জানান, বছরের এ সময় মিলাররা চালের দাম নিয়ে কারসাজি করে। এবারও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে।

নয়াবাজারের ডিম বিক্রেতা জিহাদুল ইসলাম বলেন, পাইকাররা আবারো ডিম নিয়ে কারসাজি করছেন। আড়তে সংকট দেখিয়ে পণ্যটির দাম বাড়িয়েছেন। তিনি জানান, কয়েকদিন আগেই প্রশাসনের নজরদারিতে তারা ডিমের দাম কমিয়ে বিক্রি করেছেন। নজরদারি একটু কমতে না কমতেই দাম আবারো বাড়িয়েছেন। যে কারণে খুচরা পর্যায়ে দাম বেড়েছে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আমাদের যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। অনেক ক্ষেত্রে আইন পরিবর্তনেরও প্রয়োজন আছে। আবার সরকার পতনের পর চাঁদাবাজি কিছুটা কমেছিল। এখন সেটি অন্যপক্ষ দখলে নিয়েছে বলে অভিযোগ শুনছি।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনা সমস্যার কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের কারণে কষ্টে আছে। এখন তাদের স্বস্তির জন্য মূল্যস্ফীতি কমালে চলবে না। পণ্যের মূল্য কমাতে হবে। মূল্যস্ফীতি হচ্ছে গত বছরের মূল্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি কমা মানে গত বছরের চেয়ে মূল্য এত শতাংশ কমেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য তো মূল্যস্ফীতি কমালে চলবে না।

দের জন্য পণ্যের মূল্য অর্থাৎ চাল, ডাল, পেঁয়াজ, তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্য কমাতে হবে। নিত্যদিনে মানুষের খাবারের টেবিলে যে খাদ্যগুলো থাকে, সেগুলো দাম কমাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি বলেন, মূল্য কমাতে হলে বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনার বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে বন্ধ করতে হবে চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমাতে হলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে। বর্তমান সরকার যেই কৌশলে বাজার ব্যবস্থাপনা করছে, তার সঙ্গে আগের সরকারের কৌশলে কোনো পার্থক্য নেই। ডান্ডাবাজি করা হচ্ছে খুচরা বিক্রেতাদের ওপর। অথচ যেখান থেকে বাজারের নিয়ন্ত্রণ, সেখানে হাত দেওয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশ বাজার ব্যবস্থাপনার যে ধারণা রয়েছে, এটা পুরোটাই ভ্রান্ত। সব সরকারই এই কৌশল নিয়েছে। যেটি মূলত কাজ করে না।

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের ডিন অধ্যাপক এনামুল হক বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারগুলো সবসময় জনপ্রিয়তা তৈরির জন্য অভিযান পরিচালনা করে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে কোনোভাবেই মূল্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এজন্য দরকার প্রতিযোগিতা কমিশনকে শক্তিশালী করা, বাজার প্রতিযোগিতামূলক করা এবং চাঁদাবাজি বন্ধের ব্যবস্থা করা। বাজারে কোনো কোম্পানি বা গোষ্ঠী প্রতিযোগিতা নষ্ট করছে কিনা, মূল্য বৃদ্ধিতে সিন্ডিকেট করছে কিনা, বাজার কেন অস্থিতিশীল হচ্ছে—সে বিষয়ে কাজ করে প্রতিযোগিতা কমিশন। বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে হলে প্রতিযোগিতা কমিশনকে পুনর্গঠন করতে হবে।

আমারবাঙলা/আরইউ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

মালয়েশিয়ার দূতাবাসে আটকে আছে মনিকার যোগদান

পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের আদেশের পরও মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগ দিতে পারছে...

গান বাংলার প্রধান নির্বাহী তাপস গ্রেপ্তার

গ্রেপ্তার হয়েছেন বেসরকারি টেলিভিশন গান বাংলার প্...

৬ মাসে বিদেশ গেছেন ৫ লাখের বেশি কর্মী

সাধারণ ও শিল্প শ্রমে অভিবাসী বেশি, দক্ষ কর...

ট্রাম্প না কমলা, কে হাসবেন বিজয়ের হাসি?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এখন ঘণ্টার গণনায় পড়েছে। এ নির্বাচনকে নিয়ে...

ইরানের সেই তরুণী গ্রেপ্তারের পর কোথায় আছেন অজানা!

হিজাব ঠিকমতো পরা হয়নি বলে ইরনের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে হেনস্তার শিকার হয়েছিলে...

গুম কমিশনে ১৬০০ অভিযোগ জমা

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুমের ঘটনা তদন্তে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত কমিশনে এ...

সাপ পথ চলতে আঁকাবাঁকা হয় কেন?

সাপ হাত-পা বিহীন দীর্ঘ শরীরের, মাংসাশী এক প্রকার সরীসৃপ। সোজা ও লম্বাটে ধূর্ত...

দুর্লভ তৈজসপত্রের ‘শাহজাহান সংগ্রহশালা’ 

যশোরের শার্শা উপজেলার নিজামপুর বাজারের সাইকেল মেকা...

অনেক দেশে সেনাবাহিনী নেই, নিরাপত্তা রক্ষা কীভাবে?

একটি দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেনাবা...

ঢাবির ভর্তি কার্যক্রম শুরু, থাকছে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনি কোটা 

প্রতি বছরের মতো এবারো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৪-২৫...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা