দেশে উৎপাদিত রাবারের চাহিদা কম। একইসঙ্গে অস্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে সম্ভাবনাময় খাতটি জৌলুস হারাচ্ছে।
জানা যায়, গত ছয় মাসে দেশে রাবারের দাম প্রতি কেজি ২৮০ টাকা থেকে কমে ২২০ টাকা হয়েছে। ফলে চাষি ও উৎপাদকরা ক্রমবর্ধমান লোকসানে পড়েছেন।
বান্দরবানের লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে কয়েক হাজার কর্মীর কাজের এই খাত সংকুচিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, উৎপাদকরা টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন। তাৎক্ষণিক সরকারি হস্তক্ষেপ না হলে দীর্ঘমেয়াদে এ শিল্পের ক্ষতি হতে পারে।
জানা যায়, দেশে রাবারের দাম কম হওয়ায় চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে ৩৫ দশমিক ৯৩ মিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৫ দশমিক ৯৩ মিলিয়ন ডলার।
সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেনের ভাষ্য, গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গাজী কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়ায় প্রাকৃতিক রাবারের বড় ক্রেতা এই প্রতিষ্ঠানটির ক্রয়াদেশ কমে গেছে।
গণঅভ্যুত্থানের সময় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন এই কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
গাজী টায়ার দেশে উৎপাদিত প্রাকৃতিক রাবারের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ব্যবহার করে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, কারখানা পুড়ে যাওয়ার আগে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন প্রায় ২৫ টন প্রাকৃতিক রাবার কিনত।
বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের (বিআরবি) তথ্য বলছে— বর্তমানে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার একর জমিতে রাবার চাষ হচ্ছে। প্রতি বছর প্রাকৃতিক রাবার উৎপাদন হচ্ছে ৬৭ হাজার ৯৩৯ টন। বেসরকারি উৎপাদকরা এক হাজার ৩০৪ রাবার বাগান পরিচালনা করছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করছে ২৮ বাগান। এগুলোর অধিকাংশই বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে।
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আরো বলেন, কাঁচা রাবার বিক্রি হয় বছরে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকার।
ধারণা করা হচ্ছে, রাবার বাগান গড়তে অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এতে কাজের সুযোগ হয়েছে প্রায় দেড় লাখ মানুষের।
সৈয়দ মোয়াজ্জেমের মতে, নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রাবার গাছ রোপণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বাগান মালিকরা শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ও দখল থেকে তাদের বাগান রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছেন। নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে অনেকে বাগান রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছেন না। ফলে উৎপাদন কমছে। এভাবে চলতে থাকলে সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে। এটি আরো অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনবে।
তার মতে, বাগান মালিকরা তাদের সমস্যার কথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। কিন্তু সমাধান পাননি। তিনি বলেন, রাবারশিল্প রক্ষা, দাম স্থিতিশীল করা এবং বাগান মালিক ও শ্রমিকদের নিরাপদ পরিবেশ দিতে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে আহ্বান জানাই। তা না হলে রাজস্ব হারানোর ঝুঁকি আছে।
খাগড়াছড়ি আদিবাসী রাবার বাগান মালিক সমিতির সভাপতি সমীর দত্ত চাকমা বলেন, জেলার রাবার চাষিরা কখনোই ন্যায্যমূল্য পান না।
তিনি জানান, গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে রাবার প্রতি কেজি ১৮০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা ১২০ টাকায় নেমে এসেছে।
তিনি বলেন, উৎপাদকদের তুলনায় মধ্যস্বত্বভোগীরা বেশি মুনাফা করে, ছোট কৃষকরা টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে।
তার দাবি, সিন্ডিকেট দাম নিয়ন্ত্রণ করে। সীমিত সংখ্যক প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা থাকায় সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নেই।
তিনি আরো বলেন, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কম হওয়ায় ফলের বাগানের তুলনায় রাবার বাগান বেশি লাভজনক। এই জেলার প্রায় ১০০ রাবার বাগান মালিকের আয়ের ব্যবস্থা হয়েছে।
বাংলাদেশ রাবার বাগান মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, দাম কমার অন্যতম প্রধান কারণ গাজী টায়ারের রাবার কেনা কমে যাওয়া।
তবে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি আশাবাদী। তার বিশ্বাস, অর্থনীতির পরিধি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাবারের চাহিদা বাড়বে।
‘নতুনভাবে কারখানা চালু হলে গাজী টায়ার আগের মতো রাবার কিনতে শুরু করবে’ আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, গণআন্দোলনে বাজারের আরেক বড় প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের ক্ষতি হয়নি। প্রতিষ্ঠানটি বাইসাইকেল তৈরি করে। বর্তমানে দেশে রাবারের প্রধান ক্রেতা মাত্র দুটি। ফলে তাদের ওপর সবাই নির্ভরশীল। প্রতিষ্ঠান দুটোই পুরোদমে উৎপাদনে ফিরলে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাবে।
গাজী টায়ারের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক বিপণন) মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তারা ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য সীমিত আকারে রাবার প্রক্রিয়াজাত করছেন।
তিনি আরো বলেন, আগামী আগস্টের মধ্যে উৎপাদন শুরুর লক্ষ্য আছে। আমরা বর্তমানে প্রক্রিয়াজাত রাবার সংরক্ষণ করছি। আমাদের অর্থায়নকারীরা পুনঃঅর্থায়ন অনুমোদন দেওয়ার পর উৎপাদন শুরু করব।
আমারবাঙলা/এমআরইউ