দেশে ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে বিদেশি বিনিয়োগ। সেই সঙ্গে গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য একটি সম্মেলনের আয়োজন করতে যাচ্ছে অন্তবর্তী সরকার।
আগামী ৭ থেকে ১০ এপ্রিল ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে এই সম্মেলনের লক্ষ্য বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার পাশাপাশি দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরা।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, শ্রম অসন্তোষ এবং অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে, অর্থনৈতিক সংস্কার ও বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতামূলক বিনিয়োগের গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরতে এই সম্মেলনের আয়োজন করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে— চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগ ৭১ শতাংশ কমে হয়েছে ১০৪ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন ডলার। যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের মোট বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে ১৭ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া শীর্ষ তিন বিনিয়োগকারী দেশ।
প্রাথমিকভাবে ব্যাংকিং, বিদ্যুৎ ও ওষুধশিল্পে তিন দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যুক্তরাজ্য শীর্ষ বিনিয়োগকারী হিসেবে আছে। সিঙ্গাপুর এক দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার দ্বিতীয় ও দক্ষিণ কোরিয়া এক দশমিক ছয় বিলিয়ন ডলার নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে।
জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অরগানাইজেশন (জেট্রো) ২০২৪-এর সাম্প্রতিক জরিপে নীতিগত অসঙ্গতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে উল্লেখযোগ্য বাধা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এটি পুনঃবিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করায় মূলধন দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
জাপানি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ জটিল অনুমোদন প্রক্রিয়া, করের অসঙ্গতি ও আকস্মিক নীতি পরিবর্তনকে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতির সংকট হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
যদিও বাংলাদেশ অবকাঠামো ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবু লজিস্টিক অদক্ষতা ও ধীর প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যবসা পরিচালনায় প্রভাব ফেলছে।
এ ছাড়া, টাকার অবমূল্যায়ন, মূল্যস্ফীতির চাপ ও ব্যবসা করতে বাড়তি খরচ বাংলাদেশকে এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম প্রতিযোগিতামূলক করে তুলছে।
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট নতুন বিনিয়োগের সুযোগ এবং অর্থনৈতিক সংস্কার ও নীতিগত প্রণোদনা তুলে ধরার মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ ফেরানোর সুযোগ তুলে ধরবে।
অন্তত ৫০ দেশের ৫৫০-র বেশি বিনিয়োগকারী ও আড়াই হাজার দেশি বিনিয়োগকারী সম্মেলনে অংশ নিতে নিবন্ধন করেছেন।
আগামী ৯ এপ্রিল বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে নিয়ে সম্মেলন উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বিনিয়োগবান্ধব নীতি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সরকারের অঙ্গীকারের ওপর জোর দেন।
বাংলাদেশ মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবে না। বিনিয়োগ সম্ভাবনার বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সংকটের কথা স্বীকার করে তিনি আরো বলেন, 'বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্প সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ব্যবসা সহজ করতে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগের বর্তমান মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিশীল বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে আছে। এর অভ্যন্তরীণ বাজার ক্রমশই বড় হচ্ছে। শ্রমিকদের স্বল্প মজুরি ও কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক।
তিনি স্বীকার করেন যে, দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ধরে রাখতে ধারাবাহিক নীতি, অবকাঠামোগত উন্নতি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এক সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
তার মতে, ইনভেস্টমেন্ট সামিট বিনিয়োগকারীদের নতুন করে আগ্রহের ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। বিদেশি ব্যবসায়ীদের কাছে বাংলাদেশের সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরা হবে। বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ দূর করতে নীতিনির্ধারকরা একটি প্ল্যাটফর্ম পাবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, দুই অর্থবছর ধরেই সামষ্টিক অর্থনীতির কিছু বিষয়ে সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে মূল্যস্ফীতির কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়া, ডলারের বাজারে অস্থিতিশীলতার কারণে মূলধন কমে যাওয়া এবং আমদানিতে প্রভাব পড়া অন্যতম। এসবের সঙ্গে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অস্থিরতা যোগ হয়। ফলে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটে এবং সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। সব মিলিয়ে আপাতত বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক কমে গেছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বর্তমানে দেশে বিনিয়োগের কোনো পরিবেশ নেই। গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট, ব্যাংকের সুদের হার বেশি, নানা রকমের সমস্যা, ব্যাংকগুলোর চরম অসহযোগিতাসহ নানা কারণে একেবারেই বিনিয়োগ নেই।’
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি যা নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। একদিকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যাংকগুলোর ওপর, আরেক দিক দিয়ে যদি কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হয়, তাহলে অস্থিরতা সৃষ্টি হবেই। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি ঠিক না হয় তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্য চালানো অসম্ভব। আর নতুন বিনিয়োগ তো হবেই না।’
এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, যখন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের কথা আসে তখন তারা দীর্ঘদিন ধরে সংকুচিত মুদ্রানীতি অনুসরণ করেছে। আবার যখন সরকারের ঋণের বেলায় আসে তখন কিন্তু সংকোচন নেই। নানা সংকটে ব্যবসা-বাণিজ্যে এখন বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এর একটি হলো আইন-শৃঙ্খলাজনিত, আরেকটি ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতাজনিত। সবটির মূলেই আছে রাজনীতি। তাই অর্থনীতি ঠিক করতে, বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে আগে রাজনীতি ঠিক করতে হবে।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, ‘দেশি বিনিয়োগকারীদের সুবিধা দিলে বিদেশি বিনিয়োগ এমনিই বাড়বে। কারণ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করার আগে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের জিজ্ঞেস করেন, দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি কেমন।’
তিনি বলেন, ১৫ বছর ধরে আমরা একই কথা বলে আসছি যে কেন বাংলাদেশে অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বে বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিনিয়োগকারীদের একটি কমন প্রশ্ন থাকে, বাংলাদেশে ট্যাক্স রেট আসলে কত? কোনো বেঞ্চমার্ক নেই। বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্স রেট আরোপ করায় কার্যকর মৌলিক করহারের কাঠামো নেই। এটি হচ্ছে বিনিয়োগের প্রথম বাধা। এরপর উচ্চ করের সঙ্গে আছে অসংগত নীতি। নীতি চেঞ্জ করে দেওয়া হচ্ছে যখন-তখন। এতে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েন বিনিয়োগকারীরা।
আমারবাঙলা/এমআরইউ