আঠারো শতকে ব্রিটেনের বিখ্যাত শল্যচিকিৎসক ছিলেন অ্যাস্টলে কুপার। ব্রানসবি ব্লেক কুপার ছিলেন তার ভাতিজা। খুব অল্প বয়সে ব্রিটেনের নৌবাহিনীতে যোগ দিলেও সমুদ্রে অসুস্থতার (সি-সিকনেস) জন্য নৌবাহিনীর চাকরি ছেড়ে চাচার পরামর্শে নেমে পড়েন চিকিৎসাবিদ্যায়।
চাচার মতোই হয়ে ওঠেন শল্যচিকিৎসক এবং ব্রিটেনে রয়্যাল সোসাইটির ফেলোও হন। ব্লেক কুপারের ছেলে ব্রান্সবি হেনরি কুপার আর চিকিৎসাবিদ্যায় নিজেকে জড়াননি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করতে এসেছিলেন ঢাকায়। ১৮৪৪ সালে তার দ্বিতীয় সন্তান ও প্রথম ছেলে ব্রান্সবি বিউচ্যাম্প কুপারের জন্মও এই ঢাকাতেই।
কুপার পরিবারের এই সন্তান বাপ-চাচার পেশায় নিজেকে জড়াননি। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ক্রিকেটার। বিবি কুপার নামে পরিচিত এই উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান ইতিহাসের প্রথম টেস্টে খেলেছিলেন অস্ট্রেলিয়া দলের হয়ে। অর্থাৎ, ইতিহাসের প্রথম টেস্টের সঙ্গে ঢাকার সংযোগ এই কুপারের কারণেই।
বলা যায়, ১৪৮ বছর আগে ইতিহাসের প্রথম সেই টেস্টে খেলেছিলেন বাংলাদেশের আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা এক ছেলে। সেই ছেলে বাঙালি না হতে পারেন, কিন্তু ১৮৪৪ সালের ১৬ জুলাই ঢাকারই এক চার্চে তাকে ব্যাপ্টাইজড করা হয়েছিল। এই দেশের মাটিতেই তার হামাগুড়ি থেকে হাঁটতে শেখা। সঠিক ইতিহাস না থাকলেও কল্পনা করে নেওয়াই যায়, ঢাকারই কোনো এক বাড়িতেই হয়তো কুপারের ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয়েছিল হয়তো বাবার কাছে। পরের গল্পটি বিচিত্র এবং একইসঙ্গে ঐতিহাসিক।
ইংল্যান্ডের রাগবি স্কুলে ভর্তি হয়ে কুপার ১৮৬০ থেকে ১৮৬২ পর্যন্ত ক্রিকেটদীক্ষা পেয়েছেন তখনকার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার আলফ্রেড ডিভারের হাতে। এই রাগবি স্কুলের হয়েই ১৮৬০ সালের ২৭ জুন এমসিসির বিপক্ষে প্রথম লর্ডসে খেলেন। রাগবি স্কুল ছেড়ে কুপার আর কেমব্রিজ কিংবা অক্সফোর্ডে ভর্তি হননি। হয়ে ওঠেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার। মিডলসেক্স এবং কেন্টের হয়ে খেলেন ১৮৬৯ পর্যন্ত। এরপর কিছুদিন যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়ে কুপার পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ায়।
তখন অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট কেবল হামাগুড়ি দিচ্ছে— তাদের তখনকার ক্রিকেটে দুটি ভিত ভিক্টোরিয়া ও নিউ সাউথ ওয়েলস। কুপার দাঁড় করিয়ে দেন ভিক্টোরিয়ার ক্রিকেটকে। ১৮৭৩ সালে ডব্লিউ জি গ্রেসের ইংল্যান্ড ইলেভেনের বিপক্ষে এইটিন অব ভিক্টোরিয়ার জয়ে ৮৪ রানের ইনিংস ছিল তার। ক্রিকেটের জনকখ্যাত গ্রেসের সঙ্গে কুপারের সম্পর্কটা তৈরি হয় তিনি ইংল্যান্ডে থাকতেই। এর চার বছর পর আসে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
১৮৭৬–৭৭ মৌসুমে জেমস লিলিহোয়াইটের ইংল্যান্ড দল নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া সফরে যায়। অস্ট্রেলিয়া একাদশের বিপক্ষে তারা দুটি ম্যাচ খেলেছিল, যা পরে টেস্ট ম্যাচের স্বীকৃতি পায়। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) ইতিহাসের সেই প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার ৪৫ রানের জয়ের সাক্ষীও কুপার। উইকেটকিপার হলেও পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান হিসেবে পাঁচে নেমে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে ১৫ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৩ রান করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কুপার এরপর আর কখনো টেস্ট খেলার সুযোগ পাননি। তার ওই এক টেস্টেরই ক্যারিয়ার।
অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে তখন নেতৃত্বস্থানীয় পর্যায়ে থাকলেও খেলোয়াড়দের মনোনয়নের ভিত্তিতে ইতিহাসের প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কত্ব পেয়েছিলেন ডেভ গ্রেগরি। পরের বছর অস্ট্রেলিয়া দল ইংল্যান্ড সফরে গেলেও কুপারকে নেওয়া হয়নি। কিন্তু ইংলিশ কন্ডিশনে খেলার অভিজ্ঞতা বিচারে কুপারকে নেওয়াই যেত।
সেটিও যেনতেন অভিজ্ঞতা নয়। ১৮৬৯ সালে জেন্টলম্যান বনাম প্লেয়ার্সদের ম্যাচে (অপেশাদার ক্রিকেটারদের নিয়ে জেন্টলম্যান দল পেশাদার ক্রিকেটারদের প্লেয়ার্স দল) গ্রেসের সঙ্গে উদ্বোধনী জুটিতে তোলেন ২৮৩ রান। ৩ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের এই জুটিতে গ্রেস করেছিলেন ১৮০, কুপার ১০১। রেকর্ড হিসেবে এই জুটির রান টিকেছিল পরের ২৩ বছর।
গ্রেসের চেয়ে চার বছরের বড় ছিলেন কুপার। গ্রেস যখন ১৭ বছরের তরুণ, ১৮৬৫ সালে জেন্টলম্যান অব লর্ডসের হয়ে তারা একই দলে খেলেছিলেন এবং কুপারের ৭০ রানের দারুণ এক ইনিংসও ছিল সে ম্যাচে। যেহেতু বড় ছিলেন, এটি ভেবে নেওয়াই স্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব ও খেলোয়াড়ি দক্ষতায় ক্রিকেটের সবচেয়ে বিখ্যাত দাঁড়িওয়ালার পথপ্রদর্শকও ছিলেন কুপার। মাত্র ৫০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ৮৩ ইনিংসে ২০.৫১ গড়ে ১৬০০ রান দিয়ে কুপারকে বিচারকে একটু অন্যায়ই হয় বোধ হয়। সেই সময়ের ক্রিকেট বিচারে কুপার ইংল্যান্ডে যথেষ্ট খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন।
সেই খ্যাতির শিকড়ে যেহেতু ঢাকার আলো-বাতাস, তাই একটু গর্ব লাগতেই পারে ঢাকাবাসীসহ দেশবাসীর। আরেকটা চমকপ্রদ তথ্য— কুপার ও টেস্ট ক্রিকেটের জন্ম একই দিনে, ১৫ মার্চ!
আমারবাঙলা/এমআরইউ