পৃথিবীতে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। সবকিছুরই ক্ষয় আছে, এমনকি এই পৃথিবীরও। সেসব বিবেচনায় মানুষের কীর্তি ছোট বিষয়।
পেপ গার্দিওলা। তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী এই কোচ এ প্রতিযোগিতার শেষ ষোলোয় উঠতে পারবেন না, ভাবাই কষ্টকর। গার্দিওলার কোচিং ক্যারিয়ারে এর আগে কখনো এমন কিছু দেখা যায়নি, সিটিও গার্দিওলার অধীন শেষ ষোলোর আগে কখনো বাদ পড়েনি।
সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) রাতে সেই রূঢ় বাস্তবতা দেখে ফেলার পর ম্যানচেস্টার সিটি কোচ দার্শনিকের মতো বলেছেন, কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়।
সামনে যে এমন কিছু চোখ রাঙাচ্ছে, গার্দিওলা তা টের পাননি, সেটি বলা যাবে না। ইতিহাদে প্লে-অফ প্রথম লেগ ৩-২ গোলে হারের পর রিয়ালের মাঠে ফিরতি লেগ জয় এমনিতেই খুব কঠিন। গার্দিওলার চোখে শুরুতে জয়ের সম্ভাবনা ছিল মাত্র এক শতাংশ। খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পরে সম্ভবত বলেছেন, তিনি মিথ্যা বলেছেন, জয়ের সুযোগের হার আরো বেশি। অর্থাৎ গার্দিওলা সম্ভবত ভাবেননি, সিটিতে যে রাজত্বের শুরু করেছিলেন তিনি নয় বছর আগে, সেটির অবসান ঘটবে এতটা অসহায়ভাবে।
অসহায়? সিটির প্রায় এক যুগের আধিপত্যের অবসানের কথা বলা হচ্ছে ঠিক এ কারণেই। বিবিসির মতে, দুই লেগেই সিটি যেভাবে হেরেছে, তাতে কথাটি এভাবে বলা যায়, মাদ্রিদে ম্যানচেস্টার সিটির আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে যুগাবসান ঘটল।
৩-১ গোলের হারকে সরাসরি আত্মসমর্পণ হয়তো বলা যায় না, তবে ম্যাচটি দেখে থাকলে গার্দিওলার মতো যে কেউ জানবেন সিটি সেভাবে কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি। কপালও সহায় ছিল না। চোটের কারণে আর্লিং হলান্ড একাদশে ছিলেন না, বেঞ্চে ছিলেন কেভিন ডি ব্রুইনাও। ম্যাচে চোট পাওয়ায় ৮ মিনিটে জন স্টোনসের মতো পোড় খাওয়া যোদ্ধাকেও হারিয়েছে সিটি। অর্থাৎ প্রতি-আক্রমণ থেকে মাঝমাঠ গোছানো কিংবা আক্রমণ ঠেকাতে সিদ্ধহস্ত কেউ ছিলেন না। রাজত্ব হারাতে আর কী বাকি থাকে?
যা থাকে, সেচি আসলে সিটির বাদ পড়ার নিশ্চয়তা! আর এ বিষয়ই সম্ভবত সিটির সমর্থকদের পুড়িয়েছে সবচেয়ে বেশি। মৌসুমটা যেহেতু একদমই ভালো যাচ্ছে না, আর ঘরের মাঠে প্রথম লেগ হারের পর সিটির বেশির ভাগ সমর্থকই জানতেন, রিয়ালের মাঠে শেষ রক্ষা হবে না। ছয়টি প্রিমিয়ার লিগ (টানা চারটি), চ্যাম্পিয়নস লিগ, এফএ কাপ...ক্লাব বিশ্বকাপ— এমন অনেক শিরোপা জেতা দলটি যখন টের পায় পতন অবশ্যম্ভাবী, তখন কোচের আসলে দার্শনিক হওয়া ছাড়াও উপায় নেই। নিজেদের একাধিপত্যের অবসানকে ব্যাখ্যা করতে তখনই ওটাই আশ্রয়।
গার্দিওলার কণ্ঠেও তাই ঝরল দর্শন, কিছুই চিরস্থায়ী নয়। আমরা অবিশ্বাস্য ছিলাম, তবে আজকের (কাল রাতে) ধাপে ধাপে আমাদের উন্নতি করতে হবে। আমাদের অতীত অসাধারণ, কিন্তু এখন আর তেমন নয়।
সব হারানো রাজার মতোই গার্দিওলা মেনে নিলেন প্রতিপক্ষ দলের শ্রেষ্ঠত্ব, সেরা দল জিতেছে। এটি তাদেরই প্রাপ্য। আমাদের চেয়ে ভালো ছিল। আমাদের যেটি করতে হবে, সেটি হলো বাস্তবতা মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া।
সে বাস্তবতাটা কী? সাম্রাজ্যবাদের ভাষায়, সেটি আসলে আবার নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে রাজত্ব পুনর্দখলের চেষ্টা করা। আর গার্দিওলার ফুটবলীয় ভাষায় ব্যাপারটি এমন, (প্রিমিয়ার লিগে) আমাদের হাতে এখনো ১৩ ম্যাচ আছে। আমাদের শীর্ষ চারে বা পাঁচে থেকে আবারো (চ্যাম্পিয়নস লিগে) ফেরার চেষ্টা করতে হবে।
যে দলটি লিগে সর্বশেষ চারবারই শিরোপা জিতেছে, সেই দলকেই এবার শীর্ষ চার বা পাঁচে থেকে মৌসুম শেষ করার প্রার্থনা করতে হচ্ছে—এটি রাজত্ব ছাড়া আর কী! শীর্ষে থাকা লিভারপুলের সঙ্গে ১৭ পয়েন্ট ব্যবধানে পিছিয়ে থেকে লিগ শিরোপা জয়ের দৌড় থেকে আগেই ছিটকে পড়েছে চারে থাকা সিটি। এবার ছিটকে পড়তে হলো ইউরোপের শীর্ষ ক্লাব প্রতিযোগিতা থেকেও। চলতি মৌসুমে সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত খেলা ৪০ ম্যাচের ১৩টিতে হেরেছে সিটি। গার্দিওলা তাই বলেই ফেলেছেন, এ বছরই আমরা সবচেয়ে বাজে খেলছি...আমরা দারুণ একটি দল ছিলাম, কিন্তু এ বছর অনেক কারণেই তা আর নেই।
নতুন করে শুরুর ইঙ্গিতই দিলেন গার্দিওলা। সিটিতে গার্দিওলার বর্তমান চুক্তির মেয়াদ ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত। সবকিছু ঢেলে সাজানোর শুরুটা এখন থেকেই করতে চান গার্দিওলা, আমরা শুরুও (পুনর্গঠন) করেছি। কিছু খেলোয়াড়ের বয়সও হয়েছে। সময়ের সঙ্গে ক্লাবের সবাই এটি (বাস্তবতা) মেনে নেবে।
গার্দিওলার নিজেকেও একটি বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউট পর্বে আনচেলত্তির সঙ্গে তিনি পেরে উঠছেন না। পাঁচবারের মুখোমুখিতে চারবারই হেরেছেন। আর এবার প্লে-অফ পর্বের ম্যাচটি যেন রাজত্ব হারানোরই প্রতীক। সাক্ষ্য দিচ্ছে পরিসংখ্যান—গার্দিওলা যতগুলো দলের কোচ ছিলেন, তার মধ্যে এবার এই দলের বিপক্ষেই দুই লেগ মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩৫ শট নিয়েছে রিয়াল (প্রথম লেগে ২০টি, ফিরতি লেগে ১৫টি)। গার্দিওলা তার কোচিং ক্যারিয়ারে এবারের মতো এত বেশি ম্যাচ (১৩) কখনোই হারেননি। আর আগেই বলা হয়েছে, তার দল এবার শেষ ষোলোয় ওঠার আগেই বাদ পড়েছে— চ্যাম্পিয়নস লিগে কোচ গার্দিওলার ১৬টি মৌসুমের মধ্যে এমন ঘটনা এবারই প্রথম।
আসলেই কোনো কিছু চিরস্থায়ী নয়। পৃথিবীতে কোনো রাজার শাসনই যেমন চিরকাল চলেনি, ফুটবলে তেমনি গার্দিওলারও।
আমারবাঙলা/এমআরইউ