গল্পের শুরু এক দশক আগে। গল্পটির নেপথ্য নায়ক অ্যালেক্স দে লা ইগলেসিয়া নামের বিখ্যাত এক আর্জেন্টাইন চিত্রপরিচালক। ইগলেসিয়া সে সময় লিওনেল মেসিকে নিয়ে তৈরি করেছিলেন একটি প্রামাণ্যচিত্র। ‘মেসি’ নামের সেই প্রামাণ্যচিত্রে মেসি ছাড়াও দেখা গিয়েছিল ফুটবল-দুনিয়ার আরো অনেক রথী-মহারথীকে।
আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, জেরার্ড পিকে, হোর্হে ভালদানো, ইয়োহান ক্রুইফদের মতো মহাতারকারা হাজির হয়েছিলেন সেই প্রামাণ্যচিত্রে। যেখানে তারা বলেছিলেন মেসিকে নিয়ে নিজেদের ভাবনার কথা। সেসব তারকার ভিড়ে ভ্যালেন্তিনো আকুনিয়ার পা দুটি কারো চোখে পড়ার কথা না।
প্রামাণ্যচিত্রের বাস্তবতা পেরিয়ে মেসি দেখালেন উত্থান–পতনের মহাকাব্যিক ও অনন্য সব দৃশ্য। মেসির শৈশবের গল্প ছাড়া সেই প্রামাণ্যচিত্রের প্রাসঙ্গিকতাও ক্রমে ম্লান হয়ে এল। সেই গল্প বলার সঙ্গে সম্পৃক্তরাও সম্ভবত ভুলে গেলেন গল্পটার কথা। তবে ভুলতে পারেননি একজন। সম্ভবত প্রামাণ্যচিত্রের সবচেয়ে কম আলোচিত চরিত্রও সেই মানুষটি, ভ্যালেন্তিনো আকুনিয়া।
আকুনিয়ার জন্য বিষয়টি নিছক প্রামাণ্যচিত্রে অভিনয়ের ব্যাপার ছিল না, সেটি ছিল ইতিহাসের অংশ হওয়ার।
সেই গল্পের শুরুটা ছিল এমন, ইগলেসিয়া যখন মেসিকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা ভাবছিলেন, সে সময় ইউটিউবের কল্যাণে ইগলেসিয়া ও চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান মিডিয়াপ্রো প্রোডাকশনের হাতে আসে আকুনিয়ার খেলার ক্লিপস। সেই ভিডিও ক্লিপস দেখেই এই চলচ্চিত্রনির্মাতা সিদ্ধান্ত নেন আকুনিয়াকে মেসির শৈশবের ‘বডি-ডাবল’ হিসেবে ব্যবহারের। এরপরই তিনি খুঁজে বের করেন আকুনিয়াকে।
ইগলেসিয়া আকুনিয়াকে বাছাই করার সিদ্ধান্তের আড়ালে লুকিয়ে ছিল আরেকটি সত্যি। সেটি ছিল, তখনো শৈশব না পেরোনো ছেলেটি বল পায়ে হয়ে ওঠেন ‘মেসি ২.০’। বাঁ পায়ে তার কৌশল কিংবা ড্রিবলিংয়ের দক্ষতা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল শৈশবের মেসিকে। যে কারণে ইগলেসিয়া মেসি চরিত্রে তার বিকল্প হিসেবে আর কাউকে ভাবতে পারেননি।
অন্যদিকে মেসি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ আকুনিয়ার বাবা ও অভিভাবক গুস্তাভোর ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো কারণই ছিল না। এমন প্রস্তাব তো স্বপ্নের মতোই। ফলে বিনা দ্বিধায় গুস্তাভো তার শিশুসন্তানকে সঁপে দেন ইগলেসিয়ার হাতে। তবে নাটকীয়তা কিন্তু আরো ছিল। আকুনিয়া অভিনয় করেছেন ঠিকই, কিন্তু প্রামাণ্যচিত্রের কোথাও তার মুখ দেখা যায়নি।
যেসব দৃশ্যে তাকে দেখা গেছে, সেসবে তাকে শুধু মেসির শৈশবের ক্লাব গ্রান্দোলি ও নিউয়েলসের হয়ে কারিকুরি ও ড্রিবলিং করতে দেখা গেছে। আক্ষরিক অর্থে এই চলচ্চিত্রে আকুনিয়া নয়, অভিনয় করেছে তার পা জোড়া। আরো বিশেষভাবে বললে, বাঁ পা। সেই পা এবং শরীরী ভাষা দিয়ে আকুনিয়া হয়ে ওঠেন পর্দার মেসি। বলা যায়, পা দিয়ে অভিনয় ও বাস্তবের ব্যবধানটুকু মুছে দিয়েছিলেন এই খুদে অভিনেতা ও ফুটবলার।
আকুনিয়ার পর্দার মেসি হওয়ার গল্প শুনা গেল। মুদ্রার উল্টো পিঠে আছে তার বাস্তবের মেসি বা মেসির মতো ফুটবলার হয়ে ওঠার যাত্রাও। মেসির মতোই সেই নিউয়েলস দিয়েই ২০১০ সালে ফুটবলের হাতখড়ি আকুনিয়ার। শিশু বিভাগে নিজের নৈপুণ্য দেখানোর পর বয়সভিত্তিক দলেও ছড়ান মুগ্ধতা।
প্রথম দিকে তাকে খেলানো হয় ফরোয়ার্ড হিসেবে, পরে কোচ মার্সেলো বেলুশ্চি তাকে কিছুটা পিছিয়ে আনেন মাঝমাঠে। বর্তমানে এই পজিশনেই খেলতে দেখা যাচ্ছে তাকে। আর ধারবাহিকভাবে পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পেয়ে যান ক্লাবের প্রথম পেশাদার চুক্তিও।
ক্লাব ফুটবলে দেখানো নৈপুণ্যে একপর্যায়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলের দুয়ারও খুলে দেয়। ২০২৩ সালে দক্ষিণ আমেরিকার বয়সভিত্তিক ফুটবল প্রতিযোগিতায় আর্জেন্টিনার রানার্সআপ হওয়ার পথে আলো ছড়ানোর পর সবাইকে মুগ্ধ করেন ইন্দোনেশিয়ায় আয়োজিত বিশ্বকাপেও। টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্বে জাপানের বিপক্ষে গোল করার পর আকুনিয়া বলেছিলেন, পরিবারের উপস্থিতিতে এই জার্সি পরে বিশ্বকাপে গোল করার মুহূর্তটা আমি কখনো ভুলব না।
ধারাবাহিকভাবে নৈপুণ্য দেখিয়ে এরই মধ্যে না ভুলতে পারার মতো আরো্ অনেক স্মৃতি আছে আকুনিয়ার। যার একটি ছিল মেসির সঙ্গে আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের মাঠে দেখা হওয়া এবং আর্জেন্টাইন অধিনায়কের সঙ্গে ছবি তোলাও। স্বপ্নপূরণের ধারায় এরপর যুক্ত হয় নিউয়েলসের মূল দলে অভিষেকের ঘটনা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে শনিবার (বাংলাদেশ সময়) ভোরে ব্রাজিলের বিপক্ষে দক্ষিণ আমেরিকার অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচটিতে তার পারফরম্যান্স।
যে ম্যাচে ইতিহাস গড়ে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের ৬-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছে আর্জেন্টিনা। আর ব্রাজিলের জালে আর্জেন্টিনার আধডজনবার বল জড়ানোর পথে প্রথম দুটি গোলের মূল কারিগর ছিলেন এই আকুনিয়াই। তার সহযোগিতাতেই আসে গোল দুটি। এই ম্যাচে তার উপস্থিতি বারবার মনে করিয়ে দিয়েছিল মেসিকে। সেই মেসি, যার ভূমিকায় একদিন অভিনয় করেছিলেন আকুনিয়া।
মাত্র ১৮ বছর বয়সেই যেন জাদুবাস্তবতার রোলারকোস্টার একটি চক্র পূরণ করেছেন আকুনিয়া। মেসির শহরে জন্ম, মেসির ক্লাবেই আবার ফুটবলের হাতেখড়ি, এরপর মেসির ভূমিকায় অভিনয় আর মাঠেও জাদু দেখাচ্ছেন মেসির মতোই। বাস্তবে নয়, এমন কিছু তো শুধু কারো কল্পনাতেই সম্ভব! এটি কেবল শুরু। আকুনিয়ার পরবর্তী যাত্রা কতটা মেসিময় হয়ে ওছে, তারই অপেক্ষা।
আমারবাঙলা/এমআরইউ