বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যে আজ সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) দিল্লিতে শুরু হতে যাচ্ছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) মহাপরিচালক পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলন। এই সম্মেলনকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অতীতে সীমান্তহত্যা শূন্যের কোঠায় আনার কথা দিয়েও কথা রাখেনি ভারত। ফলে এখন সময় এসেছে ভারতকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে ফেলার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত পাঁচ বছরে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন দেড় শতাধিক বাংলাদেশি। এ কারণে এবারের সম্মেলনে ভারতকে সতর্ক করার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন তারা।
সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার সীমান্তে ১৪ বছরের কিশোরী স্বর্ণা দাসকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ। এ ঘটনার পর ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনে পাঠানো এক চিঠিতে ওই ঘটনার কড়া প্রতিবাদ জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর চার দিনের মাথায় ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীতে প্রায় একই কায়দায় জয়ন্ত সিংহ নামের আরেক কিশোরকে গুলি করে হত্যা করে তারা। এ ছাড়া সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ও জমি উদ্ধারকে কেন্দ্র করে বিজিবি-বিএসএফের মধ্যেও উত্তেজনা দেখা যায়। দুই দেশের সীমান্তবর্তী বাসিন্দারাও ঝগড়াঝাটিতে নেমে যায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত বছরের ৪ থেকে ৯ মার্চ ঢাকায় ডিজি পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। গত বছরের নভেম্বর মাসে দিল্লিতে আজকের সম্মেলনটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সময় পিছিয়ে দিয়ে আজ শুরু হচ্ছে সেই সম্মেলন। এবারের সম্মেলনটি গুরুত্ব বহন করছে অন্যান্য সম্মেলনের চেয়ে। প্রতিবারই উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার দাবি জানায় বিজিবি। আর বিএসএফ এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতিও দেয়। তবে বাস্তবে তাদের প্রতিশ্রুতি কার্যকর হয় না।
সূত্র জানায়, বিএসএফের গুলিতে ফেলানী হত্যার পর বাংলাদেশের দাবির মুখে ২০১৪ সালে দিল্লিতে বিএসএফ ও বিজিবির মহাপরিচালকদের বৈঠকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে সমঝোতায় আসে। সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনায় প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার না করার ব্যাপারে ২০১৮ সালের এপ্রিলে দুদেশের মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এর পরও হত্যাকাণ্ড থেমে থাকেনি।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০২৩ সালে সীমান্তে ৩১ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়েছে। ২০২২ সালে ১৭ জন, ২০২১ সালে ১৭ জন, ২০২০ সালে ৪৯ জন, ২০১৯ সালে ৪৩ জনকে হত্যা করা হয়। গত পাঁচ বছরে হত্যার শিকার হয় ১৫৭ বাংলাদেশি।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবাধিকারকর্মী এ এস এম নাসির উদ্দিন এলান বলেন, বিজিবি-বিএসএফের বৈঠকে সীমান্ত হত্যা নিয়ে ওয়ার্নিং দিতে হবে। ভারতের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে। পৃথিবীর কোনো সীমান্তে এভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে না। বিএসএফ বাংলাদেশিদের হত্যা করে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ হয়, যেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
তিনি বলেন, চোরাকারবারির কথা বলে তারা গুলি করে, এটি মেনে নেওয়া যায় না। যদি কেউ অবৈধভাবে তাদের সীমান্তে চলে যায়, তাহলে তারা গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় নিতে পারে, বিচারবহির্ভূত হত্যা করতে পারে না।
তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের ওপর আধিপত্য বিস্তার করার মানসিকতা নিয়ে সীমান্তে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে।
বিজিবি জানায়, সীমান্ত সম্মেলন আজ সোমবার ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে শুরু হচ্ছে। বিজিবি প্রতিনিধিদলে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশে নেবে। ভারতীয় পক্ষের নেতৃত্বে থাকবেন বিএসএফ মহাপরিচালক (ডিজি) দলজিৎ সিং চৌধুরী।
এবারের সম্মেলনে সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর গুলি চালানোর বিষয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়া সীমান্তে আহত, আটক, অপহরণ, চোরাচালান, মাদকদ্রব্য, অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ বিভিন্ন ধরনের নিষিদ্ধ দ্রব্যের চোরাচালান প্রতিরোধ নিয়েও আলোচনার কথা রয়েছে। আন্তর্জাতিক সীমানা আইন লঙ্ঘন করে অবৈধ অনুপ্রবেশ; বিশেষ করে ভারত সীমান্ত দিয়ে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমার নাগরিকদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ রোধের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে।
সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়াসহ অননুমোদিত অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ ও চলমান অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজের নিষ্পত্তি; আগরতলা থেকে আখাউড়ার দিকে প্রবাহিত সীমান্তবর্তী চারটি খালের বর্জ্য পানি অপসারণে উপযুক্ত পানি শোধনাগার স্থাপন; জকিগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে রহিমপুর খালের মুখ উন্মুক্তকরণ; আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ক্যাম্পের সম্ভাব্য অবস্থান ও তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত তথ্য বিনিময়; সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও সীমান্ত সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানের জন্য ‘সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা’ কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা হবে।
এ ছাড়া আলোচ্য বিষয়ে রয়েছে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়ন এবং পারস্পরিক আস্থা ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ। আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি সম্মেলন শেষ হবে।
আমারবাঙলা/এমআরইউ