লেখক ও চিন্তাবিদ অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, সংবিধান সংস্কার কমিশন যখন গঠন হলো তখন তারা সবাই ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। সংবিধান বলতে ড. কামাল হোসেনরা কী বুঝেন!
সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, যে সংবিধান ১৯৭২ সালে লেখা হয়েছিলো সেখানে তারা বলছেন, দেশের সার্বভৌমত্ব হচ্ছে সংসদের। এটা একটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সার্বভৌমত্বের সহজ বাংলা হচ্ছে মালিকানা। আমরা বলছি সব ক্ষমতার উৎস জনগণ। আসলে ব্যাপারটা তা নয়। জনগণই হলো ক্ষমতার কেন্দ্র। কেননা, উৎস বলতে বুঝায় আপনি ক্ষমতা অন্য একজনকে দিলেন আপনার হয়ে চালাবার জন্য। তাহলে আপনি এখানে তো ক্ষমতার মালিকানা দেননি, আপনি আপনার ক্ষমতার ম্যানেজারি করার ক্ষমতা দিয়েছেন কাউকে।
মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় গুলশানের জাতীয় নাগরিক কমিটি ঢাকা উত্তর মহানগর আয়োজিত থানা প্রতিনিধি সভায় এসব কথা বলেন তিনি।
এ সময় তিনি আরো বলেন, সংসদে যারা নির্বাচিত হয়ে আসেন তারা হচ্ছেন বড়জোর ম্যানেজার। মালিকরা তাদেরকে নিয়োগ দেন। তবে তারা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে না পারেন তাহলে মালিকের অধিকার আছে তাদেরকে বরখাস্ত করার। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে বরখাস্ত কখন করবে? বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী তাদের ৫ বছর সময় দেওয়া হয়েছে। এই মেয়াদের মধ্যে যদি ওই সংসদ সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন বা বেইমানি করেন তাহলে তাদেরকে বসিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা জনগণের থাকবে। এইটার নামই হলো জনগণের সার্বভৌমত্ব।
সলিমুল্লাহ খান আরো বলেন, ‘সার্বভৌমত্ব বিষয়টি হচ্ছে অবিভাজ্য বা অখণ্ড। আমরা বাংলাদেশে এখন ১৮ কোটি মানুষ আছি। এ সব মানুষকে নিয়েই কিন্তু সার্বভৌমত্ব। একজন বা দুজনের কোনো সার্বভৌমত্ব হয় না। কিন্তু, আমরা কার্যত সার্বভৌমত্ব একব্যক্তি-এক পরিবারের ওপর ন্যস্ত করেছিলাম। এটা হচ্ছে আমাদের ঐতিহাসিক ভুল অথবা ব্যর্থতা।’
তিনি বলেছেন, সার্বভৌমত্ব বিষয়টি বিক্রয় যেমন করা যায় না তেমনই এটা কারো হাতে তুলে দেওয়া যায় না। এজন্যই সংসদ নির্বাচন করা হয় বিশেষ কিছু কাজ দেওয়া জন্য; মালিক হওয়ার জন্য নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় দার্শনিকরা বলেছেন, সার্বভৌমত্ব অবিভাজ্য অর্থাৎ এটাকে ভাগ করা যাবে না।
৭২-এর সংবিধান নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সংবিধান লিখে মুক্তিযুদ্ধ করি নাই। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার পর সংবিধান লেখা দায়িত্ব বা ক্ষমতা আমাদের এসেছিল। কিন্তু, আমরা সেটার অপব্যবহার করেছি।’
বর্তমান সংবিধানের অসংঙ্গতিগুলো তুলে ধরে সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘১৯৭২ সালে যে সংবিধান লেখা হয়েছিলো যেটা এখন অজ্ঞান অবস্থায় আছে। এই সংবিধানের মূল সমস্যাটা যেকোনো স্কুলের ছাত্রও বুঝতে পারবে। এই সংবিধানের জনগণের অধিকার রয়েছে প্রথম তিনভাগে। যেগুলো হলো প্রস্তাবনা, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং মৌলিক অধিকার।
এছাড়া বাকি যে ৮ ভাগ রয়েছে যেগুলো মধ্যে প্রথমেই রয়েছে আমলাতন্ত্রের শাসন। যার ভদ্র নাম দেওয়া হয়েছে নির্বাহী বিভাগ। যার প্রধান আমলা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি। আর এখন আমরা যে সংস্কারের কথা বলছি তার মূল কথাই হলো এই সংবিধানের গোড়াতেই রয়েছে আমলাতন্ত্রের অপ্রতিহত ক্ষমতা। এখানে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি যারা আইন প্রণয়ন করবেন তাদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এই আমলাতন্ত্র বা নির্বাহী বিভাগের পরে দেওয়া হয়েছে।’
সংবিধান সংস্কার কমিশনের নতুন প্রস্তাবনা নিয়ে তিনি বলেন, এর পর তৃতীয় ভাগে দিয়েছে বিচার বিভাগ। আর বাকিগুলোর কথা না বললেও হবে। কেননা ওগুলো সংবিধানে না রেখে অন্য আইনে করা যেতো।
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ বলেন, ‘এখন আমরা যে নতুনভাবে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবনা শুনতে পাচ্ছি, সেখানে বলা হয়েছে বিচার বিভাগকে স্বাধীন করতে হবে। কিন্তু, আপনাদের তো আগে আইন সভাকে কর্তৃত্ব দিতে হবে। তার অধীনে স্থাপন করতে হবে সরকার এবং শাসন বিভাগ ও আমলাতন্ত্রকে। এখন আপনারা যদি বলেন, এসব বিভাগকে সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য একটি সংবিধানিক কাউন্সিল তৈরি করবেন। তাহলে আমি বলবো এগুলো হলো মূল সমস্যাকে বুঝতে না পাড়ার ক্ষমা।’
এ সময় সভায় আরো বক্তব্য রাখেন ঢাবি আইন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান মাইমুল আহসান খান, জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখপাত্র সামান্তা শারমিন, মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, যুগ্ম আহ্বায়ক সারওয়ার তুষার প্রমুখ।
আমারবাঙলা/জিজি