বাংলাদেশ সচিবালয়ের সামনে বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) লাগা আগুন নির্বাপণের কাজের সময় ট্রাকচাপায় আহত ফায়ার সার্ভিস কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। সোয়ানুর জামান নয়ন নামের ওই ফায়ার ফাইটারের বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুরে। মূল কর্মস্থল সিলেটের বিশ্বনাথ ফায়ার স্টেশন হলেও সর্বশেষ তিনি তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনে দায়িত্বরত ছিলেন। নয়নকে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
তার মৃত্যুতে উপদেষ্টা পরিষদে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। বৃহস্পতিবার ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম অংশ নেন। পরে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রংপুরে।
আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত ফায়ার ফাইটার নয়ন পানির লাইন দিতে রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাক চাপায় গুরুতর আহত হন। পরে তাকে আহত অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হয় বলে ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যার হাউজ ইন্সপেক্টর আনোয়ারুল ইসলাম জানান।
পরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ৭টার দিকে সচিবালয়ের সামনে ব্রিফিংয়ে এসে নয়নের মৃত্যুর খবর দেন। তিনি বলেন, আহত অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তার মৃত্যু হয়।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, দায়িত্ব পালনে তেজগাঁও থেকে ছুটি গিয়েছিলেন স্পেশাল ইউনিটের এই সদস্য। যুক্ত হয়েছিলেন আগুন নেভানোর কাজে। পানির পাইপ সংযোগ দিতে সচিবালয়ের রাস্তার উল্টো পাশে যাওয়ার সময় বেপরোয়া গতির একটি ট্রাক ধাক্কা দেয় তাকে। মুমূর্ষু অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি নয়নকে।
ট্রাকটি নয়নকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় গণপূর্ত অধিদপ্তর এলাকায় জনতা ট্রাকচালক বেলাল হোসেন সুমন এবং তার সহকারী ফরহাদকে ধরে পুলিশে দেয়। ৩৫ বছর বয়সী সুমন ও ২০ বছর বয়সী ফরহাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। শাহবাগ থানায় মামলা করেন ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের সদস্য রুহুল আমিন মোল্লা। পরে তাদের আদালতে হাজির করে কারাগারে নেওয়ার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার এসআই আমিরুল ইসলাম। আসামিদের পক্ষে কোনো আইনজীবী আদালতে ছিলেন না। পরে ঢাকা মহানগর হাকিম মিনহাজুর রহমান তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
নয়নের মৃত্যুর ঘটনায় সড়ক পরিবহন আইনে ট্রাকচালক বেলাল হোসেন ওরফে সুমন (৩৬) ও হেল্পার ফরহাদের (২০) বিরুদ্ধে ঢাকার শাহবাগ থানায় মামলা করেন ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের সদস্য রুহুল আমিন মোল্লা।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়ন ২০২২ সালে ৬১তম ব্যাচে যোগ দিয়েছিলেন অগ্নি নির্বাপক বাহিনীতে। তিনি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার আটপনিয়া গ্রামের আক্তারুজ্জামানের ছেলে। ২৪ বছর বয়সী নয়ন ছিলেন দুই ভাইবোনের মধ্যে ছোট।
নয়নের জানাজায় উপদেষ্টা, বললেন আমাদেরই ব্যর্থতা
ফায়ার ফাইটার নয়নের দক্ষতার জন্যই তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল বলে জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। নয়নের জানাজায় অংশ নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ওই সময় ওই সড়কে ট্রাক চলতে পারাটা একভাবে কর্তৃপক্ষেরই ‘ব্যর্থতা’।
বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় বঙ্গবাজারে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরে নয়নের জানাজা হয়। তার আগে তার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পক্ষ থেকে।
জানাজার পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, আল্লাহই তাকে শহীদের মর্যাদা দান করবেন। তিনি খুবই ভালো ফাইটার ছিলেন বলে তাকে স্পেশাল টিমের জন্য আনা হয়েছিল। তার জন্য দোয়া করব, আল্লাহ যেন কবরের আজাব মাফ করেন।
উপদেষ্টার ভাষ্য, ওই জায়গা দিয়ে ট্রাক যাওয়াটা আমাদের ব্যর্থতাই। ট্রাক ওই জায়গা দিয়ে যাওয়া উচিত ছিল না। তবে আমরা ট্রাক চালককে ধরে ফেলেছি। তাকে আমরা আইনের আওতায় অবশ্যই নিয়ে আসব। জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আমার একজন মারা গিয়েছে, এটি আমার ব্যর্থতা। অনেকেই এসব ভুলে যাবে, কিন্তু মা-বাবা ভুলবে না। তার মা বাবা যেন ভালো থাকতে পারে, সে বিষয়ে যা দেখা দরকার আমরা দেখব। জানাজার পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সোয়ানুর জামান নয়নের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তার মা-বাবার খোঁজ-খবর নেন।
সড়ক বন্ধ না করায় আফসোস নয়নের স্বজনদের
অগ্নিকাণ্ডের শুরুতেই সচিবালয়ের সামনের সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দিলে ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়ন ট্রাক চাপায় মারা যেত না বলে মনে করেন স্বজনরা। নয়নের চাচাতো ভাই রাকিবুল ইসলাম বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, সে যখন আহত হল, তারপর সড়ক বন্ধ করা হল। পাঁচ মিনিট আগে সড়ক বন্ধ করা হলে সে মারা যেত না। এই ঘটনা সম্পূর্ণভাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ব্যর্থতা।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বঙ্গবাজারে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদর দপ্তরে নয়নের জানাজা হয়। জানাজার পর নয়নের মামা রকিব মাসুদ ও চাচাতো ভাই রাকিবুল ইসলাম সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
চোখের জলে নয়নকে বিদায় জানালো ফায়ার সার্ভিস
নয়নের অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না পরিবার ও সহকর্মীরা। ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তর প্রাঙ্গণে নয়নের জানাজা তার শেষ বিদায় জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন সবাই। সহকর্মীরা নিহত নয়নের কর্ম-দক্ষতার বিভিন্ন স্মৃতিচারণ করেন। অশ্রুশিক্ত হয়ে পড়েন সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ফায়ার সার্ভিসের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা।
এর আগে দুপুরে জাতীয় পতাকায় মোড়ানো ফায়ার ফাইটার নয়নের মরদেহ জানাজার জন্য ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরে আনা হয়। জানাজার আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ফায়ার ফাইটার নয়নকে শ্রদ্ধা জানান। এরপর তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় বিদায় জানানো হয়।
চির-ছুটি পেলেন নয়ন
বৃহস্পতিবার সকালেই ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল ফায়ার ফাইটার নয়নের। সমস্ত প্রস্তুতি শেষ। ব্যাগও গুছিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু গত বুধবার দিবাগত মধ্যরাতে সচিবালয়ে আগুনের খবরে ডাক পড়ে তার। সব ফেলে ছুটে যান আগুন নেভাতে।
সহকর্মীরা জানান, বৃহস্পতিবার সকালেই ছুটিতে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বড়বালা ইউনিয়নে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল তার। রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু মাঝরাতে ডাক পড়ায় ঘুম থেকে উঠেই যোগ দিয়েছিলেন পেশাগত দায়িত্ব পালনে। সেখানে প্রাণ হারিয়ে এখন বাড়ি ফিরছে তার নিথর দেহ।
নয়নের মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ মা-বাবা
সচিবালয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে নিহত ফায়ার ফাইটার সোহানুজ্জামান নয়নের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। একমাত্র ছেলে নয়নকে হারিয়ে মা পাগল হয়ে গেছে। দুই সন্তানের মধ্যে নয়ন ছিল ছোট। বড় বোন সুমির বিয়ে হয়ে গেছে।
সন্তানের মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর থেকে কাঁদতে কাঁদতে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন মা নার্গিস বেগম। সন্তান হারানোর ব্যাথা সইতে না পেরে নিজের বুক চাপড়ে আহাজারি করছেন তিনি। নিহতের স্বজনরা বলছেন, নয়নই ছিল পরিবারের ভরসা। তাকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখতেন তার মা-বাবা ও বোন। কিন্তু হঠাৎ এমন মৃত্যুতে যেন পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেল। এমন মৃত্যু তারা মেনে নিতে পারছেন না।
আমারবাঙলা/এমআরইউ