এক যুগ আগে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সংবিধানের যে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করা হয়েছিল, তার কিছু অংশ বাতিল ঘোষণা করেছেন হাই কোর্ট। ফলে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের যে বিধান আওয়ামী লীগ করেছিল, তা বাতিল হয়ে গেল। তার জায়গায় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরলো।
এদিকে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পুরোটা আদালত বাতিল করেননি বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। তারা বলছেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত করা কয়েকটি ধারা আদালত বাতিল করেছেন। বাকিগুলো ভবিষ্যৎ সংসদের জন্য রেখে দিয়েছেন।
অন্যদিকে হাই কোর্টের রায়ে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসার পথ খুলেছে, তার সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে সাংঘর্ষিক হবে না বলে মনে করছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে করা দুই রিট মামলার রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাই কোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) এ রায় দেন।
রায়ে আদালত বলেছেন, বিগত তিন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনগণের আস্থাকে ধ্বংস করেছে।
এদিকে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে আসার ক্ষেত্রে বড় বাধা দূর হলো। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখনই ফিরে এসেছে বলা যাবে না; কারণ, সেটি বাতিল করা হয়েছিল দুইভাবে। আদালতের রায় ও সংসদ কর্তৃক সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে। এ বিষয়ে আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন হয়েছে। জানুয়ারিতে শুনানি হবে। সেটি আবেদনকারীদের পক্ষে নিষ্পত্তি হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরবে।
২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৫৪টি ক্ষেত্রে সংযোজন, পরিমার্জন ও প্রতিস্থাপন আনা হয়েছিল। এর মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে রায়ে।
পাশাপাশি পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত ৭ক, ৭খ, ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।
৭ (ক) অনুচ্ছেদে অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান যুক্ত করা হয়েছিল।
৭ (খ) সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য করার কথা বলা ছিল।
সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ বিষয়ে বলা ছিল এবং ৪৪ (২) অনুচ্ছেদে বলা ছিল, এই সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীন হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতার হানি না ঘটাইয়া সংসদ আইনের দ্বারা অন্য কোন আদালতকে তাহার এখতিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে ঐ সকল বা উহার যে কোন ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা দান করিতে পারিবেন।
আদালত বলেছেন, সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে গণভোটের কথা ছিল, যা পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাতিল করা হয়। এ বিধান বিলুপ্তি সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ৪৭ ধারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ’ বিবেচনায় তা বাতিল ঘোষণা করা হল এবং দ্বাদশ সংশোধনীর ১৪২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হল।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটা বাতিল করা হচ্ছে না। বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে আগামী জাতীয় সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে।
তত্ত্বাবধায়ক বৃত্তান্ত
১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকারের অধীনে হয় সাধারণ নির্বাচন হলেও তখন বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত করা হয়নি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের চাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংসদে পাস করে বিএনপি।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৮ সালে অ্যাডভোকেট এম সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন।
পরের বিএনপি সরকারের সময়ে ২০০৪ সালের ৪ অগাস্ট সেই রিট খারিজ হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধই থাকে।
হাই কোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে আপিল করেন রিটকারীরা। ২০০৬ সালে রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে জরুরি অবস্থা জারির পর গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর এ পদ্ধতির দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
পরে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে ২০১০ সালের ১ মার্চ আপিল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে আপিল আবেদনকারী এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছাড়াও অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে শীর্ষস্থানীয় আট জন আইনজীবী বক্তব্য দেন।
তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। এমনকি তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও এর পক্ষে মত দেন।
ওই আপিল মঞ্জুর করে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়। তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন এবিএম খায়রুল হক।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার আগেই ২০১১ সালের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তিসহ ৫৫টি সংশোধনীসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রস্তাব জাতীয় সংসদে পাস হয়। একই বছরের ৩ জুলাই তাতে অনুমোদন দেন রাষ্ট্রপতি।
ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। আগে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনে নির্বাচন করার বিধান থাকলেও ওই সংশোধনীতে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিষয়টি সংযোজন করা হয়।
এ ছাড়া জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়; সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল করা হয়; রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
পাশাপাশি অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ বিবেচনায় সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান যুক্ত করা হয় সংবিধানে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফেরানোর দাবি আবারো জোরালো হয়। পঞ্চদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে গত ১৮ আগস্ট রিট আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ ব্যক্তি।
প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট গত ১৯ অগাস্ট রুল দেন। পঞ্চদশ সংশোধনী কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।
পরে বিএনপি, গণফোরাম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি সংগঠন এবং কয়েকজন ব্যক্তি এ রিট মামলায় পক্ষভুক্ত হয়, তাদের পক্ষে আইনজীবীরা শুনানিতে অংশ নেন।
গত ৩০ অক্টোবর শুনানির পর নভেম্বরে নয় দিন (৬ নভেম্বর, ৭ নভেম্বর, ১০ নভেম্বর, ১৩ নভেম্বর, ১৪ নভেম্বর, ২০ নভেম্বর, ২৫ নভেম্বর, ২৭ ও ২৮ নভেম্বর) এবং ১ ডিসেম্বর ও বুধবার (৪ ডিসেম্বর) রুলের ওপর শুনানি হয়।
এদিকে পঞ্চদশ সংশোধনীর ১৭টি ধারার বৈধতা নিয়ে নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন গত অক্টোবরে একটি রিট আবেদন করেন।
ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২৯ অক্টোবর হাই কোর্টের একই বেঞ্চ রুল দেয়। রুলে আইনের ওই ধারাগুলো কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। পরে সেই রুলের ওপর শুনানি হয়।
মঙ্গলবার রায়ের দিন রাষ্ট্রপক্ষে আদালতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুল জব্বার ভুঁইয়া, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদ উদ্দিন।
রিটকারী বদিউল আলমের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া। বিএনপির পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল।
জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির, ব্যারিস্টার এহসান এ. সিদ্দিকী।
ঐতিহাসিক রায়
রিটকারীদের আইনজীবী শরিফ ভূঁইয়া রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, রায়ের ব্যাপারে আমরা খুব খুশি। কারণ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেটির অবসানের ক্ষেত্রে আজকে গুরুত্বপূর্ণ একটা মাইলফলক অর্জন করলাম।
তিনি বলেন, যেহেতু নির্বাচন, গণতন্ত্র এগুলো বাংলাদেশ সংবিধানের মূল কাঠামো এবং যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গণতন্ত্র এবং নির্বাচনকে সুসংহত করে, সেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও সংবিধানের একটি মূল কাঠামো। এ কারণে আজকে আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে শুধুমাত্র সাংবিধানিক নয়, সাংবিধানিক এবং সংবিধানের মূল কাঠামোর অংশ বলে রায় দিলেন। সেটি আমি মনে করি, একটি ঐতিহাসিক।
তবে এই আইনজীবী মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এখনই ফিরে আসছেÑ তা বলা যাবে না। কারণ, ওই ব্যবস্থাকে দুইভাবে বাতিল করা হয়েছিল। প্রথমত, মাননীয় আপিল বিভাগ বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে একটি রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। এবং পরবর্তীতে সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করে। কাজেই, এটাকে দুইভাবে বাতিল করা হয়েছিল। পঞ্চদশ সংশোধনী যেহেতু বাতিল হল, সংসদের মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করা হয়, সেই প্রতিবন্ধকতা আমরা পার হয়ে এলাম। কিন্তু আমাদেরকে এখনো বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে যে রায়, সেটার পুনর্বিবেচনা এবং সেটা পরিবর্তিত হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসার জন্য।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। সেই সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে।
জানুয়ারি তৃতীয় সপ্তাহে সেই শুনানি হবে জানিয়ে শরিফ ভূঁইয়া বলেন, ওই আবেদনের রায় যদি রিভিউ আবেদনকারীদের পক্ষে নিষ্পত্তি হয়, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরবে।
তিনি বলেন, আমরা পঞ্চদশ সংশোধনীর পুরোটা বাতিল চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি (হাই কোর্ট) অন্যান্যগুলো রেখে দিয়েছেন, সেখানে বলেছেন, সেগুলো উনি বৈধতাও দিচ্ছেন না। ভবিষ্যতে যে সংসদ আসবে তাদের জন্য রেখে দিয়েছেন। ভবিষ্যৎ সংসদ জাতির প্রয়োজনে সেগুলো রিভিউ করে রাখতে পারেন, চাইলে বাতিলও করতে পারেন। এর ফলে যে নির্বাচন হবে, সেটা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হবে। যেটা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হবে।
জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পূর্ণরূপে বাতির ঘোষণা করা হয়নি। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে সমস্ত পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন করা হয়েছিল, তার কিছু অংশ তিনি রেখে দিয়েছেন। কিছু জিনিস বাতিল করেছেন আর কিছু জিনিস পরবর্তী সংসদের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। তার মাধ্যমে যে সমস্ত জিনিস তিনি সংরক্ষণ করেছেন, তার মধ্যে একটি হলো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। আরেকটি হলো, পরিবেশগত বায়োডাইভারসিটির প্রিন্সিপাল, আরেকটি সংরক্ষণ করেছেন, যেটি হল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রের যে নীতি।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত কী বলেছে, তা তুলে ধরে শিশির মনির বলেন, উনি বলেছেন, আামদের সংবিধানের মূল নীতিহলো উই, নট আই। উই দ্য পিপল, পিপলের ইচ্ছায় সর্বোচ্চ ইচ্ছা। আর্টিকেল ৭-এ বলা আছে, জনগণের ইচ্ছাটাই হলো সর্বোচ্চ আইন। এবং উনি বলেছেন, এজন্যই পার্লামেন্ট প্রয়োজন হয়, আমাদের সংবিধানে আই-এর কোনো বিধান নাই। বিধান হলো উই, আমরা, জনগণ। উনি বলেছেন, সংবিধানে বেসিক স্ট্রাকচার ডকট্রিন নামে একটা ডকট্রিন আছে। বেসিক স্ট্রাকচার ডকট্রিন হল এমন ডকট্রিন, যেগুলো সংবিধান চাইলেও সংশোধন করতে পারবে না, পরিবর্তন করতে পারবে না। তিনি বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এমন কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, যেখান সংবিধানে যে ফেব্রিক, সেই ফেব্রিকটাকে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির প্রতিক্রিয়া
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, বিএনপির হাতে জন্ম নেওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি আওয়ামী লীগ তাদের স্বার্থে বাতিল করেছিল। আদালত মানুষের কথা চিন্তা করে ভোটের অধিকারের কথা চিন্তা করে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনতে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছেন। এ রায়কে বিএনপি স্বাগত জানায়। মানুষ ভোট দেবে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে। ভোটে যারা জয়লাভ করবে তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবে। জোর করে মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করা ঠিক নয়। আওয়ামী লীগ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে জোর করে ক্ষমতা দখল করেছিল। দিনের ভোট রাতেই করে ফেলেছিল। শেষে কী হলো? ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হলো।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিক বাতিল বাংলাদেশের মানুষের জন্য বড় একটি সুখবর। বিজয়ের মাসে গণতন্ত্রের বিজয় আরো একধাপ এগিয়ে গেলো। আদালতের এমন রায়কে স্বাগত জানায় বিএনপি। ফ্যাসিবাদী সরকারের দিয়ে যাওয়া অবৈধ আদেশ বাতিল করেছেন আদালত। আদালতের এই রায় নিঃসন্দেহে বিএনপির জন্য একটি বড় সুখবর। আমরা আশা করি, দেশের মানুষও এটা চায়। মানুষ আর কতদিন ভোট ছাড়া থাকবে?
জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে: মিয়া গোলাম পরওয়ার
দেশের উচ্চ আদালতের রায়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে জনগণের অধিকার পুনপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন।
বিবৃতিতে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের ভোট ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছিল।
এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিনা ভোটে ক্ষমতা দখলের প্রবণতা তৈরি হয়। ফলে গত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচনের নামে তামাশা হয়েছে মাত্র। মূলত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে।
মঙ্গলবার দেশের উচ্চ আদালতের রায়ে জনগণের অধিকার পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হলো। এটি জনগণের আরেকটি বিজয়। আমরা দেশবাসীকে এই আইনি লড়াইয়ে জনগণের ভোটাধিকার পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আন্তরিক অভিনন্দন ও মোবারকবাদ জানাচ্ছি।
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বললেন আমি গর্বিত
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। যুগান্তকারী এ রায় প্রদানকারী হাইকোর্ট বেঞ্চের নেতৃত্বে ছিলেন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। তার সঙ্গে ছিলেন বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরী। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব রায়টি লিখেছেন এবং পুরো রায়টি আদালত কক্ষে ঘোষণা করেছেন।
মঙ্গলবার রায় ঘোষণা শেষে পঞ্চদশ সংশোধনী মামলা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের তিনি ধন্যবাদ জানান।
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, এত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিয়ে আপনারা একজন নারী বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এসেছিলেন। একজন নারী বিচারপতির ওপর আস্থা রেখেছেন, এ কারণে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এটা আমার জন্য বড় পাওয়া। এ রায় দিতে পেরে আমি গর্বিত। আমি মনে করি, নারী জাতির জন্য এটি গর্বের বিষয়। এ রায় দেওয়ার সময় আমরা জনগণের চাওয়া ও অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করেছি।
পরে আইনজীবীরাও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও ধন্যবাদ জানান।
আমারবাঙলা/এমআরইউ