ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা থেকে বাস ভাঙচুরের অভিযোগকে কেন্দ্র দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা তুমুল সংঘর্ষে জড়িয়েছেন।
বুধবার (২০ নভেম্বর)। বেলা আড়াইটায় ঢাকার সায়েন্সল্যাব মোড়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত। সন্ধ্যা ৬টার দিকে নিজ ক্যাম্পাসে ফিরে যান ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। তার আগেই সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক ছাড়েন। প্রায় তিন ঘণ্টার সংঘর্ষে সায়েন্সল্যাব এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। মিরপুর রোডে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
সংঘর্ষের মধ্যে সেখানে কিছু বাস ভাঙচুরের খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ৩০-এর অধিক শিক্ষার্থী। তারা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ অনেক হাসপাতালে চিকিতসা নিয়েছেন। সংঘর্ষ শেষে সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ। এ সময় নয় দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়।
এদিকে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ থামাতে পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী ছিল। সর্বশেষ এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (রাত ৮টা) ঢাকা ও সিটি কলেজ ক্যাম্পাসে পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন আছে। সংঘর্ষের মধ্যে পুলিশসহ উভয়পক্ষের বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, ছোট একটি হাতাহাতি ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও মারামারি শুরু হয়। প্রথম দিকে পুলিশ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের রাস্তা থেকে সরানোর চেষ্টা করছিল।
একপর্যায়ে পরিস্থিতি এমন সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠল যে শিক্ষার্থীদের হতাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা গেল। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। এর মধ্যে সিটি কলেজের ছেলেরা এলাকা ছেড়ে গেলেও ঢাকা কলেজের ছেলেরা তাদের কলেজের সামনে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অবস্থান নেন।
সংঘর্ষে আহতদের অনেকে হলেন- শাহরিয়ার (২১), নূর হোসেন (২৪), মো. তুষার (১৮), অনিম (২১), সিজান (১৮), রিফাত (২১), আরাফাত (২১), নিরব (২১), শরিফ (২১), ইয়াকুব (১৮), মেহেদী হাসান (২১), আল ইমরান (১৮), তানভীর (১৮), সুজন (১৮), আরিফ (১৭), মহিউদ্দিন (২৩), তারেক (৩২), তাহসিন (১৮), ফয়সাল (১৮), তরিকুল ইসলাম রাজীব (২৫), মো. আলী (১৭), হাসান (১৮), ইসমাইল (১৮), ফাইয়াদ (১৮), মাহির (১৭), সাকিন (১৮), তানভীর (১৮), তামিম (১৮), তাসফিকুর রহমান (১৭), আশিক (১৮), রাজ (১৮) ও মেহেদী (১৮)।
ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থী ওয়ালিদ হোসেন বলেন, সকালে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো একটি ঘটনা নিয়ে হাতাহাতি হয়। দুপুর আড়াইটায় ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস থেকে দুটি বাস ছেড়ে সিটি কলেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। তখন সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা ওই বাস দুটি ভাঙচুর করে। এ ঘটনার জেরে সংঘর্ষ শুরু হয়।
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সকালে ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থীকে একা পেয়ে সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা মারধর করেন। পরে দুপুরে ঢাকা কলেজের একটি বাসে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে কাচ ভেঙে দেওয়া হয়।
ঢাকা কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী জুবায়ের আরেফিন প্রিয় অভিযোগ করেন, আনুমানিক দুপুর সোয়া ১২টার দিকে কলেজ থেকে হেঁটে বাসায় ফেরার সময় ধানমন্ডি ১ নম্বর রোডে ১০-১৫ জন কলেজ ছাত্র দৌড়ে এসে আমার মাথার পেছন দিকে আঘাত করতে শুরু করে। শার্টের পকেট ছিঁড়ে আইডি কার্ড ছিনিয়ে নেয়। আমি তাদের বলি, ভাই আমি তো কিছুই করিনি, তাহলে কী সমস্যা। তারা বলল, এটি কলেজে কলেজে মারামারি, তুমি বুঝবে না। ছেলেগুলো কলেজ ড্রেস পরে ছিল কিন্তু গলায় কোনো আইডি কার্ড ছিল না। সাদা শার্ট-কালো প্যান্ট ও ঘাড়ে ব্যাগ ছিল। আশপাশের মানুষের মন্তব্যে বোঝা গেছে তারা সিটি কলেজের ছাত্র।
সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ শিক্ষার্থী আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে মেডিক্যাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক ওমর ফারুক জানিয়েছেন।
এদিকে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার মধ্যে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে পুলিশ। এরপর সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা পিছু হটেন। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা সায়েন্সল্যাব মোড়ের কাছে কিছুক্ষণ অবস্থান নিয়ে ক্যাম্পাসের দিকে চলে যান। শিক্ষার্থীরা সড়ক ছেড়ে যাওয়ার পর বিকাল ছয়টার দিকে ওই এলাকায় যান চলাচলা শুরু হয়েছে। দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের এই সংঘর্ষের মধ্যে বিকাল সাড়ে চারটার দিকে নিউমার্কেট ও চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের ফটকে তালা লাগিয়ে দেন ব্যবসায়ীরা।
গত অক্টোবরের শেষ দিকে সিটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষকে অপসারণের দাবি জানিয়েছিলেন কলেজটি শিক্ষার্থীরা। ওই ঘটনা নিয়ে জটিলতার মধ্যে কলেজটি দীর্ঘ ২০ দিন বন্ধ রাখার পর মঙ্গলবার থেকে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালু হয়। এর একদিন না যেতেই শিক্ষার্থীরা সংঘাতে জড়ালেন।
সিটি কলেজ সরিয়ে নেওয়ার দাবি
সিটি কলেজকে বর্তমান অবস্থান থেকে সরিয়ে নেওয়াসহ নয় দফা দাবি জানিয়েছেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঢাকা কলেজ অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এ দাবি জানান।
আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ঢাকা কলেজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আ ক ম রফিকুল আলম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন অধ্যক্ষ এ কে এম ইলিয়াস এবং অন্যান্য শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও পুলিশ প্রশাসনের সিনিয়র কর্মকর্তারা।
দাবিগুলো হলো-
১. দেড়শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আহত শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি শিক্ষকরাও আহত হয়েছেন।
২. আমাদের স্থাপনায় সেনাবাহিনী সরাসরি হামলা ও ভাঙচুর করেছে। যা আমাদের জন্য লজ্জানজক। এ হামলায় সংশ্লিষ্ট জড়িত প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. বিশেষ করে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা যারা এই হামলার নির্দেশ দিয়েছেন তাদের পদত্যাগ করতে হবে।
৪. ইতোপূর্বে সকল বিশৃঙ্খলার সঙ্গে সিটি কলেজ কতিপয় সন্ত্রাসী শিক্ষার্থীরা দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় এবং পরবর্তী সংঘর্ষ এড়াতে সিটি কলেজকে স্থানান্তর করতে হবে।
৫. সিটি কলেজের যেসব শিক্ষকরা এই নিন্দনীয় ঘটনা সরাসরি নির্দেশ দিয়েছে এবং জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
৬. এই ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সশরীরে ক্যাম্পাসে এসে পরিদর্শন করতে হবে।
৭. এই হামলায় জড়িত সেনা ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করতে হবে।
৮. বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সাত শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন এবং শত শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন তাই পরিকল্পিতভাবে ঢাকা কলেজের ১৮৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে হামলা করে বর্তমান সরকারতে ব্যর্থ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। যাতে সরাসরি সিটি কলেজ এবং পুলিশ জড়িত ছিল।
৯. ঢাকা কলেজের ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই সকল দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে ঢাকা কলেজে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
আমার বাঙলা/এনবি