বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) ভর্তি অনেকে বুধবার (১৩ নভেম্বর) বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠানটির সামনে সড়কে অবস্থান নিয়েছিলেন। পরে তাদের শান্ত করতে দিবাগত রাত আড়াইটায় ওই সড়কে ছুটে গিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের চারজন উপদেষ্টা ও প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার একজন সহকারী। তাদের দাবি পূরণের আশ্বাসে প্রায় সাড়ে ১৩ ঘণ্টা পর সড়ক থেকে হাসপাতালে ফিরতে রাজি হন আহতরা।
আগারগাঁও এলাকায় অবস্থিত নিটোর বা পঙ্গু হাসপাতাল এবং পাশের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অর্ধশতাধিক ব্যক্তি বুধবার দুপুর ১টা থেকে হাসপাতালের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছিলেন। এই ব্যক্তিদের কারো এক পা নেই, কেউ হুইলচেয়ারে, আবার কারো চোখে ব্যান্ডেজ রয়েছে। তারা এক পর্যায়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান দেন। পরে হাসপাতালে ফিরে যেতে চারজন উপদেষ্টাকে সেখানে উপস্থিত হওয়ার শর্ত দেন।
সেই শর্ত অনুযায়ী উপদেষ্টারা না যাওয়ায় রাত ১২টার পর হাসপাতাল থেকে বিছানাপত্র এনে সামনের ওই সড়কে অবস্থান চালিয়ে যান আহত ব্যক্তিরা। কেউ শুয়ে, কেউ বসে সময় পার করতে থাকেন। এই অবস্থা চলার মধ্যে রাত আড়াইটার সময় সেখানে হাজির হন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এবং প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় সহকারী (স্বাস্থ্য) হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সায়েদুর রহমান।
উপদেষ্টারা ভুল স্বীকার ও দুঃখপ্রকাশ করেন। তারা আহতদের দাবি–দাওয়া নিয়ে আলোচনার জন্য বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) দুপুর ২টায় সচিবালয়ে বৈঠকে বসার কথা বলেন। আহতদের প্রতিনিধি দলের যাওয়ার জন্য দুটি গাড়ি পাঠাবেন বলে জানান। আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য একটি রূপরেখা তৈরি করে ডিসেম্বরের মধ্যে তা বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন।
প্রথমে আহতদের উদ্দেশে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘এখন এখানে আপনাদের কথা শোনার মতো উপযুক্ত সময় নয়। আপনারা কাল ২টার সময় সচিবালয়ে আসেন। সেখানে আলোচনার ভিত্তিতে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে। সেই রূপরেখা ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।’ এখন পর্যন্ত সুষ্ঠু ব্যবস্থা না হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আপনাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা হবে।’
এ পর্যায়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমাদের ব্যর্থতা, আমাদের ভুল আছে। কিন্তু চেষ্টার দিক দিয়ে আমাদের ঘাটতি ছিল না। যে কোনো কারণেই হোক আমরা পারিনি। আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখুন, আমরা একটি কংক্রিট (সুষ্পষ্ট) রূপরেখা দিব, লিখিত দিব।’
নিজেদের দুর্বলতার কথা স্বীকার করে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘একটি ভঙ্গুর অবস্থার মধ্যে আমরা দায়িত্ব নিয়েছি। বহু সমস্যা দেখা দিয়েছে। আসুন আমরা আলোচনার ভিত্তিতে একটি রূপরেখা তৈরি করি। সেটি ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, তা দেখার জন্য আপনারা একটা টিম করবেন।’
স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সহকারীর দায়িত্বে আসা ড. সায়েদুর রহমান আহতদের দেশের সেবা চিকিৎসা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেন, ‘আমরা একটি সুযোগ চাই। আমাদের একটি সুযোগ দিন। কোনো ব্যত্যয় হলে আমরা দায়িত্বে থাকব না।’
আর উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘আমরা কথা দিচ্ছি, আপনাদের সমস্যাগুলোর সমাধান করব। না পারলে তখন যা ইচ্ছা করবেন, কোনো আপত্তি থাকবে না। তবে আপনাদের সুষ্ঠু চিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা হবে।’
এরপর আহতরা হাসপাতালে ফিরতে রাজি হন। তখন উপদেষ্টারা তাদের নিয়ে হাসপাতালে ঢোকেন। রোগীদের হাসপাতালের শয্যায় পৌঁছে দিয়ে পঙ্গু হাসপাতাল এবং জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি অন্য রোগীদের দেখে রাত সোয়া ৪টার পর উপদেষ্টারা বাসার উদ্দেশে যাত্রা করেন।
গত জুলাই–আগস্টে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় আহত হওয়া ব্যক্তিদের এই ক্ষোভ–বিক্ষোভের শুরু হয় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শনকে কেন্দ্র করে। আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের দেখতে বুধবার সকালে তিনি পঙ্গু হাসপাতালে যান। তার সঙ্গে ছিলেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সবার সঙ্গে দেখা করেননি— এ অভিযোগে হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় তার পথ আটকে বিক্ষোভ করেন আহত ব্যক্তিরা। পরে তারা রাস্তায় নামেন।
ফলে আগাররগাঁও থেকে শ্যামলীমুখী সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। জরুরি প্রয়োজনে আসা গাড়ি ছাড়া আর কোনো গাড়ি চলাচল করতে পারেনি রাত অবধি। আহত ব্যক্তিদের সড়কে বসে বিক্ষোভের পুরোটা সময় সেখানে বিপুলসংখ্যক সেনা ও পুলিশ সদস্য অবস্থান করেন। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা আবার এসে তাদের সঙ্গে দেখা না করা পর্যন্ত তারা রাস্তা ছাড়বেন না। পরে বলা হয়, চারজন উপদেষ্টাকে আসতে হবে। এভাবে বিক্ষোভ চলতে থাকে। রাত নয়টার দিকে আহত ব্যক্তিরা স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে স্লোগান দেওয়া শুরু করেন।
সন্ধ্যার পর প্রথম দফায় ঘটনাস্থলে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আন্দোলনে নিহত মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধও বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলতে যান। তবে তাদের অনুরোধে আহত ব্যক্তিরা রাস্তা ছাড়েননি। একপর্যায়ে তারা সেখান থেকে চলে আসেন।
হাসনাত আবদুল্লাহ রাত ১২টার আগে আবার ঘটনাস্থলে যান। এ সময় তার সঙ্গে থাকা দুজনের সঙ্গে আহত কয়েকজনের ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। তবে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তা শান্ত হয়।
আমারবাঙলা/এমআরইউ