নিজস্ব প্রতিবেদক: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশ অনুযায়ী আগামী জাতীয় বাজেটে দেশের স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ প্রয়োজন, এতে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই দেশের নাজুক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্রটি বেরিয়ে এসেছে।
একদিকে যেমন দেশের স্বাস্থ্যখাত মহামারি মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছিলো, অন্যদিকে এর বিভিন্ন দুর্বলতাও সামনে এসেছে। অনেকে স্বাস্থ্য খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। অনেক বিশেষজ্ঞ জোর দিয়ে বলছেন, শুধু বরাদ্দ বৃদ্ধি স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুর পরিস্থিতি পরিবর্তন করবে না, এজন্য দরকার বরাদ্দ বাস্তবায়নের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কার্যকর ব্যবহার।
এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে বছরের পর বছর ধরে কেনাকাটায় অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের অভিযোগ রয়েছে। সরকারি স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশার কারণে বাংলাদেশ একটি বৃহৎ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। যেখানে চিকিৎসা সেবা নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতে কিছু অর্জনের পাশাপাশি কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে কিন্তু সবার জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এ খাতের জন্য যথাযথ ও পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ অপরিহার্য। দেশের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনা মূল্যে প্রয়োজনের মাত্র ১.৬২ শতাংশ ওষুধ পায় রোগীরা। ৯৬.৪৬ শতাংশই ওষুধ কিনতে হয় বাইরের দোকান থেকে। আর বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, এনজিও ও অন্যান্য সুবিধা থেকে মেলে ২ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। "স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন,“স্বাস্থ্য বাজেটের বরাদ্দ আপাতত মোট জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ৭% থেকে ১০% হওয়া উচিত। এবং, সরকারকে স্বাস্থ্য খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সক্ষমতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত স্বাস্থ্য খাতের জন্য রুটিন বাজেট তৈরি করা। বাজেট প্রথাগত হলে মানুষ বাজেটের সুফল পাবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবিলম্বে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, “স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের বাজেটে বরাদ্দ অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। আমি স্বাস্থ্য খাতে মোট বাজেটের কমপক্ষে ১০% দাবি করছি, যদিও গত বছর এটি ছিল মাত্র ৫%।
তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো এবং বাজেট সঠিকভাবে কাজে লাগাতে স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম সহ সমস্ত লজিস্টিক সহায়তা নিশ্চিত করা জনগণের জন্য যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন,” যোগ করেন শরফুদ্দিন আহমেদ।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্যখাতের জন্য মোট বাজেটের ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো। আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দ ছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে মোট ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট হচ্ছে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেট। এই বাজেটের আকার দাঁড়াচ্ছে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এটি চলতি বাজেটের তুলনায় ৪.৬০ শতাংশ বেশি, টাকার অঙ্কে বাড়ছে ৩৫ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেট ব্যয়ের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী বাজেটের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমানো। আর এই লক্ষ্য পূরণ করতে মূলত পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো হতে পারে, অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত বা কমানো হতে পারে, অযৌক্তিক ব্যয় কমানোর দিকনির্দেশনা থাকতে পারে, কিছু খাতে অর্থ সরবরাহ কমিয়ে আনা হতে পারে, কমানো হতে পারে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকির পরিমাণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের কমপক্ষে ১২%-১৫% বরাদ্দের সুপারিশ করে ডব্লিউএইচও। তিনি আরো বলেন, “সকল নাগরিকের জন্য যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে মোট জাতীয় বাজেটের অন্তত ১০% স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা উচিত।”
সৈয়দ আবদুল হামিদ স্বাস্থ্য খাতের জন্য যথাযথ বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ চাহিদা মূল্যায়ন করার উপরও জোর দিয়েছেন। ডব্লিউএইচও এর মতে একটি দেশের জিডিপির ন্যূনতম ৫% স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় করা উচিত।
এবি/এইচএন