সৈয়দ জাফরান হোসেন নূর: বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা এবং উদ্যোগ গ্রহণ সত্যেও সীমান্তে হত্যা কমছে না। সীমান্ত হত্যা বন্ধে গত মাসে রাজধানী ঢাকার পিলখানায় বিজিবির সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিজিবি-বিএসএফ’র মহাপরিচালক পর্যায়ের পাঁচ দিনব্যাপী ৫৪তম সীমান্ত সম্মেলন।
চলতি বছরের যৌথ সীমান্ত সম্মেলন পরবর্তী (গত ২৬ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল) গত আট দিনের ব্যবধানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লালমনিরহাট ও নওগাঁ সীমান্তে তিন বাংলাদেশী নিহতের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া পৃথক এসব ঘটনায় চারজন আহত হয়েছেন।
এদিকে গত মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) দিবাগত রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে এক বাংলাদেশি নিহত এবং অপর একজন আহত হয়েছেন। নিহত সাইফুল ইসলাম (৩০) রাধানগর ইউনিয়নের মৃত হাসান আলীর ছেলে এবং আহত রাজু হলেন একই ইউনিয়নের ভোলার ছেলে।
সংবাদ মাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করে গোমস্তাপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) চৌধুরী জুবায়ের আহমেদ বলেন, বিএসএফ’র গুলিতে একজন নিহত ও একজন আহতের বিষয়ে শুনেছি। ঘটনা জানার পর আমাদের একটি টিম পাঠানো হয়েছিল। ঘটনাটি ভারতের অভ্যন্তরীণ। তিনি আরও বলেন, শুনেছি মরদেহ বিএসএফ নিয়ে গেছে।
উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের মেম্বার রফিকুল ইসলাম জানান, ভারত থেকে গরু আনার জন্য মঙ্গলবার দিবাগত রাতে রোকনপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে যায় কয়েকজন যুবক। এই সময় বিএসএফের সদস্যরা গুলি ছুড়লে ঘটনাস্থলে সাইফুল ইসলাম নিহত হন। এই ঘটনার পর সাইফুল ইসলামের মরদেহ বিএসএফ নিয়ে যায়।
তবে এ ঘটনায় নওগাঁ-১৬ বিজিবির অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল মুহম্মদ সাদিকুর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এরআগে গত ২৯ মার্চ মধ্য রাতে লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জে বিএসএফ’র গুলিতে আরও এক বাংলাদেশি নিহত হন। এ সময় আরও দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলার বুড়িরহাট সীমান্তের ৯১৩ নম্বর পিলারের ভারতের ১০০ গজ অভ্যন্তরে এ ঘটনাটি ঘটে। নিহত মুরুলী চন্দ্র কালীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের উত্তর বালাপাড়া গ্রামের সুশীল চন্দ্রের ছেলে। আহতরা হলেন- একই এলাকার চন্দ্রপুর গ্রামের আজিমুল হকের ছেলে মিজানুর রহমান ও নুর ইসলামের ছেলে লিটন।
জানা যায়, গরু পাচারকারী চক্রের ৪/৫ জন ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সহায়তায় ওই রাখালরা গরু পাচার করতে ভারতে প্রবেশ করেন। ভারতীয় গরু নিয়ে বুড়িরহাট সীমান্ত দিয়ে ফিরছিলেন তারা। এ সময় তাদের লক্ষ্য করে বিএসএফ কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়লে ৩ বাংলাদেশি রাখাল গুলিবিদ্ধ হয়। পরে আহতদের উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে রংপুরে নেয়ার পথে মারা যান মুরুলী চন্দ্র। নিহতের লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে কালীগঞ্জ থানা পুলিশ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কালীগঞ্জ থানার ওসি ইমতিয়াজ কবির বলেন, বুড়িরহাট সীমান্ত এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া মুরলী চন্দ্রের মরদেহ উদ্ধার করে থানা হেফাজতে নিয়েছি। এ ঘটনায় তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এর আগে নওগাঁ জেলার পোরশা সীমান্তে গত ২৬ মার্চ ভোর সাড়ে ৪ টার দিকে ভারতীয় বিএসএফ’র গুলিতে আল আমিন (৩৩) নামে এক বাংলাদেশি যুবকের মৃত্যু ঘটে।
প্রসঙ্গত, গত ২৮ মার্চ দিবাগত রাত ৪ টার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ সীমান্তে ভারতের অভ্যন্তরে শ্মশান ঘাট নদীর পশ্চিম পাশে বিএসএফের গুলিতে মো. আলাউল (২০) নামে বাংলাদেশি এক যুবক আহত হন।
উল্লেখ্য, সীমান্ত হত্যা বন্ধে চলতি বছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পিলখানায় বিজিবির সদর দপ্তরে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের পাঁচ দিনব্যাপী ৫৪তম সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের প্রতিনিধি দল এবং বিএসএফ মহাপরিচালক নীতিন আগারওয়ালের নেতৃত্বে নয় সদস্যের ভারতীয় প্রতিনিধি দল অংশ নেন।
বিজিবির সদর দপ্তরে সীমান্ত সম্মেলনের শেষ দিনে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বিজিবি প্রধান বলেন, 'আমরা দুই দেশের অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা সিদ্ধান্তের পৌঁছেছি উভয় দেশের জন্য মঙ্গলজনক বিষয়গুলোতে আমরা যৌথভাবে কাজ করব। এর মধ্যে থাকবে চোরাচালান প্রতিরোধ, সীমান্ত অপরাধ ও সীমান্ত হত্যা পুরোপুরি বন্ধ।'
বিএসএফ প্রধান বলেন, 'সীমান্ত হত্যা বন্ধে আমাদের উদ্যোগের পরও ভারত ও বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যু হচ্ছে। বাংলাদেশ সীমান্তে আমরা অস্ত্রনীতি পরিবর্তন করেছি। প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র ব্যবহার করছি। এর মাধ্যমে যতদূর সম্ভব অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।
'সীমান্ত এলাকায় অপরাধী চক্র বেশ সক্রিয়। তারা দায়িত্বরত বিএসএফ ও বিজিবি সদস্যদের ওপরও হামলা চালায়। কখনো কখনো দুই পক্ষকেই আত্মরক্ষায় গুলি চালাতে হয়,' যোগ করেন তিনি।
এ সময় সীমান্ত হত্যা বন্ধে আরও নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন তিনি।
আমরা যৌথভাবে সীমান্ত পাহারা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি জানিয়ে বিএসএফ প্রধান বলেন, আন্তঃসীমান্ত অপরাধ বন্ধে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসবের মাধ্যমে আশা করছি সীমান্ত হত্যা কমে আসবে বলেও জানান তিনি।
এবি/এইচএন