নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশে ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড বজায় রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সকলকে বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন। একই সাথে রমজানকে সামনে রেখে যে কোনো ধরনের খাদ্য মজুদ ও ভেজালের বিরুদ্ধেও কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেন।
তিনি বলেন, ‘বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে সঠিকভাবে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে কিনা তা সবাইকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শুধু সিটি করপোরেশন এলাকায় নয়, দেশের অন্যান্য স্থানেও এটি অনুসরণ করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ তাঁর কার্যালয়ের (পিএমও) শাপলা হলে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) চার দিনব্যাপী বার্ষিক সম্মেলন উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্থাপনা নির্মাণে যেন বিল্ডিং কোড মেনে করা হয় সেদিকে সবাইকে দৃষ্টি দিতে হবে। শুধুমাত্র যেখানে সিটি কর্পোরেশন আছে সেখানেই নয়, সার্বজনীনভাবে প্রত্যেক জায়গায়ই এই বিষয়টা মানতে হবে। অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত আলো বাতাস সরবরাহের ব্যবস্থা, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা এগুলো রেখেই নির্মাণ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ বেইলি রোডের দুর্ঘটনা কবলিত স্থানে দ্রুত ছুটে যাওয়ায় এবং জনগণের পাশে দাঁড়ানোয় ঢাকা জেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানান।
তিন ফসলি আবাদি জমি বাড়িঘর বা শিল্প-কারখানাসহ অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না মর্মে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে তিনি মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ফসলি জমিকে রক্ষা করতে হবে’।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার দেশের উন্নয়ন করছে, পাশাপাশি দেশের মানুষের অধিকারও নিশ্চিত করা দরকার।
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ অতিমারি এবং ইউক্রেন -রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়েছে। পৃথিবীতে এখন এমন দেশও রয়েছে যেখানে মূল্যস্ফীতি ৪০ ভাগে উঠে গেছে। বাংলাদেশেও এর থেকে দূরে নয়, যদিও বাংলাদেশে এখনো মূল্যস্ফীতি ১০ ভাগের নিচে রয়েছে। কিন্তু তারপরও সমস্যা রয়ে গেছে। আমাদের সব সময় লক্ষ্য রাখতে হবে আমাদের বাজার পরিস্থিতি কেমন রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সামনে রমজান মাস আসছে। এ সময় কিছু কিছু ব্যবসায়ী সব সময় মজুদদারি করে, পণ্যের দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটতে চায়। সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে, কেননা এটি আমাদের আশু করণীয় কাজ ।
তিনি বলেন, ‘কোথাও যেন ভোক্তাদের কোনরকম হয়রানির শিকার হতে না হয়। আমাদের দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে। পরনির্ভরশীলতা কমাতে হবে, আর এটা যে আমরা করতে পারি সেটা কিন্তু আমরা অনেক ক্ষেত্রে প্রমাণ করেছি। সেদিকে একটু নজর দেয়া একান্তভাবে দরকার’।
শেখ হাসিনা বলেন, আরেকটি বিষয় হচ্ছে সরবরাহ। সেটা নিয়েও সমস্যার সৃষ্টি হয় অথবা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। কেউ কেউ মজুদদারি করে । পণ্য পচিয়ে ফেলবে তবু বাজারে ছাড়বেনা। সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়ে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
তিনি বলেন, ‘ রমজান মাসকে সামনে রেখেই এ কথাগুলো আমি সবার আগে বললাম। যাতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য যথাযথভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দিকে সবাইকে নজর দিতে হবে’।
তিনি খাদ্যে ভেজাল দেয়া প্রতিরোধেও জেলা প্রশাসকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, রোজা আসলেই এই সমস্যাগুলো বেশি পরিমাণে দেখা দেয়। এগুলোর দিকেও নজর দেয়া একান্তভাবে দরকার।
জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন স্বাগত বক্তব্য দেন এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া ও বক্তব্য রাখেন।
বিভাগীয় কমিশনারদের পক্ষে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার মো. সাবিরুল ইসলাম এবং জেলা প্রশাসকদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রামের ডিসি আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান ও গাইবান্ধার ডিসি কাজী নাহিদ রসুল।
অনুষ্ঠানে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্ভাবন, সেবা এবং সার্বিক উন্নয়নের ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়।
আমাদের সমাজে কিশোর গ্যাং সমস্যা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যাবে এবং পড়াশোনা করবে সেই সময় এই সমস্যাটা দেখা দেয়। এটি কোভিড-১৯ চলার সময় বিস্তার লাভ করেছে বলে তিনি উল্লেখ করে বলেন এ সময়ই এটি সবচেয়ে থেকে বেশি সামনে এসেছে।
তিনি বলেন, এজন্য এলাকাভিত্তিক নজরদারী বাড়াতে হবে। যারা লেখাপড়া করবে তারা তা না করে কেন বিভিন্ন অসামাজিক কাজে জড়াবে? এ ব্যাপারে কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকদের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভিভাবকদের নিয়ে সকলের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যেন কারো ছেলে মেয়ে এ ধরনের কিশোর গ্যাং, জঙ্গি, সন্ত্রাস ও মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়তে না পারে। সেজন্য প্রতিটি পরিবারকে নিজের সন্তান-সন্ততিদের প্রতি নজরদারি বাড়াতে হবে।
প্রতিকারের থেকে প্রতিরোধের দিকে মননিবেশ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, পরিবারগুলোকে একটু সচেতন করতে হবে, শুধু গ্রেফতার করে বা ধরে লাভ নেই। সেক্ষেত্রে সেখানে থাকা বড় অপরাধীদের সংস্পর্শে এসে এরা আরো বড় কোন ধরনের অপরাধ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে পারে। সে কারণে গোড়া থেকেই আমাদের ধরতে হবে এবং পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে।
তিনি মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে জনগণকে কর প্রদানে উৎসাহিতকরণ ও সচেতনতা সৃষ্টি, সার্বজনিন পেনশন স্কিম গ্রহণ, সমবায়ের মাধ্যমে কৃষিকে উৎসাহিতকরণ, সেচ কাজে সোলার প্যানেলের ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ ও সমন্বিত বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার এবং দেশের প্রতি ইঞ্চি অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণের আহবান জানান।
পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব মোকাবিলায় সচেতনতা সৃষ্টি, ভ’গর্ভস্থ পানির ব্যবহার রোধ করে ভ’উপরিস্থ জলাধার সংরক্ষন ও এর ব্যবহার নিশ্চিত করা, লবনাক্ততা প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় খননকার্য চালানো, জনগণের সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে পানি শোধনাগারগুলোর রক্ষনাবেক্ষন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের কর্মসূচিগুলো সম্পর্কে তদারকি নিশ্চিত করা ও যথাযথ প্রাপ্যরাই এর সুবিধা পাচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করা, আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলোর উপকারভোগীদের খোঁজ খবর নেয়া ও তাদের সমস্যার সমাধান, যুব সমাজকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠায় সরকারের সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগানোয় উৎসাহিত করার এবং ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী করে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে কারিগারি শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করার আহবান জানান তিনি।
তিনি বলেন, যত বেশি ছেলে-মেয়েদের খেলাধূলা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে তত বেশি সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ, মাদকসহ তাদের মাঝে বিভিন্ন অপরাধ প্রবনতা কমে আসবে। এজন্য তিনি উপজেলা ভিত্তিক মিনি ষ্টেডিয়াম নির্মার্ণের প্রকল্পগুলার দ্রুত বাস্তবায়ন এবং বছর জুড়ে শিক্ষার্থীদের জন্য নানারকম প্রতিযোগিতার আয়োজনে জেলা প্রশাসনকে নজর দেয়ার আহবান জানান।
সরকারের প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে নজর রাখার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রকল্পগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা এবং এগুলো কতটুকু স্থানীয় জনগণের কাজে আসবে সে বিষয়ে প্রয়োজনে তাঁকে সরাসরি রিপোর্ট প্রদানের আহবান জানান তিনি। শুধু নাম কা ওয়াস্তে প্রকল্প যেন না করা হয় সে বিষয়ে তিনি সকলকে পুনরায় সচেতন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন, স্মারক এবং গণকবর সংরক্ষণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসকে আগামী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার পাশাপাশি শহিদ দিবস ও আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসসহ জাতীয় দিবসগুলোর তাৎপর্য নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্যও তিনি তাদের প্রতি আহবান জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়েছে। এখন লক্ষ্য ২০৪১ সাল নাগাদ জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ স্মার্ট সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
তিনি ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সরকারি কর্মচারিদের উদ্দেশ্যে জাতির পিতার ভাষণের উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরে সরকারি কর্মচারিদের জনগণের সেবায় আরও আত্মনিয়োগের আহবান জানান।
জাতির পিতা বলেছিলেন,“সরকারি কর্মচারি ভাইয়েরা আপনাদের জনগণের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থকে সবকিছুর উর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। এখন থেকে অতীতের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিবর্তন করে নিজেদের জনগণের খাদেম বলে বিবেচনা করতে হবে।”
তিনি বলেন, এই জনগণের অর্থেইতো আপনারাও চলেন, আর আমরা যারা এখন মন্ত্রি ও প্রধানমন্ত্রী তারাও চলি। কাজেই জনগণের সেবা করাটাই আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। তাদের সেবা করতে হবে। সেটা মাথায় রেখেই সকল কাজ আমাদের হাতে নিতে হবে এবং সম্পন্ন করতে হবে। এই কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যও তিনি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ভোট দিয়ে পুনরায় সরকার পরিচালনায় সুযোগ করে দেয়ার মাধ্যমে উন্নয়নের ধারাবাহিতা অব্যাহত রাখার সুযোগ প্রদানের জন্য আবারও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন. আমি ১৯৭৫ সালের পর যে নির্বাচনগুলো প্রত্যক্ষ করেছি এবং অংশ নিয়েছি, তারমধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সবচেয়ে সুষ্ঠু,অবাধ এবং গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠানে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
‘সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধারাবাহিকভাবে সরকারে আছি তার মানে এই নয় যে ক্ষমতাকে শুধু ভোগ করতে এসেছি।
তিনি বলেন,“আমি আমার বাবার মতোই বলতে চাই- আমি জনগণের সেবক। জনগণকে সেবা দিতে এবং তাদের জন্য কাজ করতে এসেছি। লাখো শহিদের রক্তে রঞ্জিত আমাদের পতাকা, আমাদের স্বাধীনতা। একথা আমাদের ভ’ললে চলবে না।”
সরকারের উন্নয়ন কাজে ‘পরশ্রীকাতরতায়’ ভুগে জনগণের সামনে তাঁর সরকারের অবাধ তথ্য প্রবাহের সুযোগ নিয়ে মিডিয়ার বিভিন্ন টক শো’তে বিকৃতভাবে উপস্থাপনেরও সমালোচনা করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে দেশকে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে রেখে যান। যেখান থেকে তাঁর সরকার দেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে তুলে এনেছে এবং ২০২৬ সাল থেকে সে যাত্রা শুরু হবে।
তিনি বলেন, ‘তখন উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যে সুবিধাগুলো আমরা পাব সেটা যেমন আমরা কাজে লাগাব তার সাথে সাথে যে চ্যালেঞ্জগুলো আসবে সেগুলো মোকাবিলা করার প্রস্তুতি আমাদের এখন থেকে নিতে হবে।’
এবি/এইচএন