গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদল হয় দেশে। তারপর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। তারপর থেকে ক্রমশ উচ্চারিত হচ্ছে নতুন নির্বাচনের বিষয়টি। ঠিক সমভাবে উচ্চারিত হচ্ছে সংস্কারের বিষয়ও। বিএনপিসহ অনেক দল নির্বাচনের সঠিক দিণক্ষণ জানতে চায়। আর প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের অনেক উপদেষ্টা নানা সময় নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে নানা কথা বলে আসছেন।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সর্বশেষ বক্তব্য ঘিরে রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে, নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়ের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা এত দিন যে অবস্থান প্রকাশ করেছিলেন, সর্বশেষ বক্তব্যে তার আগের অবস্থান আবার কিছুটা নড়চড় হয়েছে। অনেকের মতে, এতে সরকার সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি করবে এবং নির্বাচন নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা গত শুক্রবার ঢাকায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠকে সরকারের বিভিন্ন রকম সংস্কারের উদ্যোগ এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলেন। সেখানে তিনি নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার প্যাকেজ’ নিয়ে একমত হয়, তবে নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে পারে। তবে তারা যদি ‘বৃহৎ সংস্কার প্যাকেজ’ গ্রহণ করে তাহলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে অনুষ্ঠিত হবে।
জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন করে ভাবনায় ফেলছে। দলগুলো সংশয়ে পড়েছে, প্রধান উপদেষ্টা ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার’ এবং ‘বৃহৎ সংস্কারের’ আলোচনা তুলে নির্বাচনপ্রক্রিয়া বিলম্বিত করার দিকে যাচ্ছেন কিনা।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, এর বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের যদি বেশি সময় দরকার হয়, তাহলে সেটিও পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন। যাতে রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষ ধোঁয়াশায় না থাকে। সেটি না করে ‘অল্প সংস্কার’, ‘বেশি সংস্কার’, ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার’, ‘বৃহৎ সংস্কার’—এমন বিষয় সামনে আনা হলে সব মহলে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ থাকে। এতে সরকার সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝি বাড়াবে। বিভিন্ন রকম সংশয়-সন্দেহ তৈরি হবে।
অবশ্য বিএনপি আগামী ডিসেম্বর নাগাদ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে আরও আগে থেকেই সংশয়ে রয়েছে। গত সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ সভায় নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন করেন নেতারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর এই সংশয়ের মূলে রয়েছে নির্বাচন নিয়ে সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য এবং নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের নানা কথাবার্তা। সর্বশেষ এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দুটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাকে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এখন দেশে যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, পুলিশ যে রকম নাজুক অবস্থায় আছে; এ রকম অবস্থায় নির্বাচন করাটা অনেক বেশি কঠিন হবে।
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, তারা আঁচ করছিলেন, সরকারের ভেতর থেকেই নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রচেষ্টা রয়েছে। এরই মধ্যে ‘বৃহৎ সংস্কার প্যাকেজ’ গ্রহণ করা হলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে হবে বলে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য সামনে এসেছে।
যদিও গত ১৬ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়ের কথা বলেছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, অল্প সংস্কার করে নির্বাচন চাইলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে, আর আরেকটু বেশি সংস্কার করে নির্বাচন চাইলে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। এরপর একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও ব্যক্তিত্বকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করছে তার সরকার। নির্বাচন কমিশনও (ইসি) সেভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলেছে। এখন ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার’, ‘বৃহৎ সংস্কারের’ প্রশ্ন তুলে আগামী বছরের জুনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ওঠায় রাজনৈতিক মহলে সংশয় তৈরি হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কার আনা। এ লক্ষ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন হয়েছে। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাব জমা দিয়েছে। পুলিশ ছাড়া বাকি পাঁচটি কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত চেয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে ঐকমত্য কমিশন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা যেটি বলেছেন, তাতে ওনার আগের কমিটমেন্টের পরিবর্তন মনে হয়। তিনি অল্প সংস্কার আর বৃহৎ সংস্কার বলতে কী বোঝাতে চাইছেন পরিষ্কার নয়। বৃহৎ সংস্কার বলতে হয়তো বোঝাতে চান, সাংবিধানিক সংস্কার। এটি (সংস্কার) পরবর্তী সংসদের ওপর ছাড়তে হবে। আর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তারা হয়তো ঐকমত্যের সনদে পৌঁছাতে চান। এগুলোর জন্য তো বেশি সময় লাগার কথা না।’
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, ‘সংস্কার কোনটা সংক্ষিপ্ত, কোনটা বিস্তৃত— সেটা ডিসাইড (ঠিক) করবে কে? তাহলে তো এটি ঠিক করার জন্য আরেকটা কমিশন করতে হবে। আমরা মনে করি, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো হওয়া দরকার। তারপর নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা ঠিক করে নির্বাচনের প্রস্তুতির দিকে অগ্রসর হওয়া দরকার। কিন্তু এর গতি স্লো (ধীর), গতি আরো দ্রুত হওয়া উচিত।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘সংস্কার তো এখনো শুরু হয়নি। মাত্র থিওরিটিক্যাল কাজ হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলেছে, ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব এসেছে। তো যেগুলোতে ঐকমত্য হবে, সেগুলো করব। যেগুলোতে ঐকমত্য হবে না, করব না। এখানে ছোট বা বড় বলতে তো কিছু নেই। আমরা চাই প্রয়োজনীয় সংস্কার, অর্থাৎ যে সংস্কারে একটি কোয়ালিটি (মানসম্মত) নির্বাচন হয়, সেটিই করতে হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপি বড় সংস্কারে যাচ্ছে না। বড় সংস্কার হবে সংসদে। ছোটখাটো নির্বাচনী সংস্কার হতে পারে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়, হবে। আর যেগুলোতে ঐকমত্য হবে না, সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের ম্যান্ডেট নিতে নির্বাচনে যাবে। জনগণ যাকে ম্যান্ডেট দেবে, সে সংস্কার করবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সংস্কারে এক-দেড় মাসের বেশি লাগার কথা নয়। সে হিসেবে আগামী জুন-জুলাইতে নির্বাচন হতে পারে।’
আমারবাঙলা/এমআরইউ