জালাল উদ্দিন ওমর: পৃথিবীতে মানুষের বসবাস প্রায় ২০ হাজার বছর ধরে। বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রায় ৮০০ কোটি। আদম ও হাওয়ার মাধ্যমে মানবসভ্যতার সূচনা, যা আজো অব্যাহত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। পুরুষ ও নারী হচ্ছে মানুষের দু’টি সত্তা। শারীরিক গঠন, আচার-আচরণ ও অনুভূতির দিক দিয়ে এরা আলাদা দু’টি অস্তিত্ব। নারী ও পুরুষ একে অপরের পরিপূরক, সহযোগী ও পরস্পর নির্ভরশীল। তারা পরস্পরের প্রতিযোগী নয়। নারী ছাড়া পুরুষের জীবন যেমন অপূর্ণাঙ্গ এবং অর্থহীন, পুরুষ ছাড়া নারীর জীবনও ঠিক তেমনি।
পুরুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নারীর এবং নারীর জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পুরুষের। পুরুষ ও নারীর মধ্যকার পারস্পরিক আকর্ষণ, ভালোবাসা ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা সৃষ্টিগত, চিরন্তন ও শাশ্বত। পারস্পরিক আকর্ষণ থেকেই সৃষ্টি হয় ভালোবাসার। সেই ভালোবাসার স্থায়ী রূপ দিতেই পুরুষ ও একজন নারী পরস্পর একত্র হয়, বিয়ে করে ও যৌথ জীবনের সূচনা করে, যাকে আমরা দাম্পত্য জীবন বলি, সংসার বলি। নারী-পুরুষের যৌথ জীবন, একসাথে বসবাস, একসাথে পথচলাই সংসার জীবনের ধর্ম।
নারী-পুরুষের ভালোবাসায় সৃষ্টি হয় নতুন প্রাণ, সংসারে জন্ম নেয় নতুন মানুষ। সন্তানের জন্মে নতুন আনন্দে ভরপুর হয় স্বামী-স্ত্রীর মন, সংসার হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। সন্তানকে ঘিরেই পিতা-মাতা বোনেন নতুন স্বপ্ন। এতেই মানব জীবনের পূর্ণতা। এভাবেই বয়ে চলে জীবনের নদী।
সংসার যদি ভালোবাসায় পূর্ণ, প্রেমময় হয়, তাহলে মানুষের জীবনও সুখের হয়। সংসারে ভালোবাসা না থাকলে জীবনেও দুঃখ নেমে আসে। সংসার ভেঙে গেলে সংসারের সবার জীবনে বিপর্যয় ও অশান্তি নেমে আসে। সুতরাং যেকোনো উপায়ে সংসারে ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে হবে, তাকে স্থায়ী করতে হবে। তার জন্য সংসারকে টেকসই, মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে হবে। সংসারে ভাঙন নয়; বরং সম্পর্ক জোড়া লাগাতে হবে। মনে রাখতে হবে- বিচ্ছেদ নয়, প্রেমময় দীর্ঘ দাম্পত্যই জীবনকে সুখী করে।
মানুষের জীবনে সংসার একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় বিষয় হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এই সংসারজীবনে বিচ্ছিন্নতা ও বিচ্ছেদের প্রবণতা রীতিমতো ভয়ঙ্কর। কারণ, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ বা তালাক কোনো অবস্থাতেই মঙ্গলজনক নয়।
সম্প্রতি প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকায় এখন প্রতি ৪০ মিনিটে একটি সংসারের বিচ্ছেদ হচ্ছে। দেশের সর্বত্রই বিয়েবিচ্ছেদ হচ্ছে এবং সময়ের সাথে সাথে এর সংখ্যা বাড়ছে। বিয়েবিচ্ছেদ ঘটার ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারী উভয়েই দায়ী হলেও নারীরা বেশ এগিয়ে রয়েছে। প্রতি ১০টি বিয়েবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে সাতটিতেই নারীরা বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেছে।
এই তথ্য সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়া বিয়েবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু সিটি করপোরেশনের মধ্যস্থতা ছাড়াও, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে প্রতিনিয়তই অনেক বিয়েবিচ্ছেদ কার্যকর হচ্ছে। সুতরাং সংসার ভাঙার প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি।
পশ্চিমা দেশগুলোতে বিয়ে ও সংসার জীবন তো বহুলাংশেই ভেঙে পড়েছে। সেখানকার অনেক মানুষ লিভ টুগেটার করে, সন্তান জন্ম দেয় এবং যখন ইচ্ছা পরিত্যাগ করে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ বা তালাকের এই প্রবণতা ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত সর্বত্র বিদ্যমান; বরং বিচ্ছেদের হার উচ্চ শিক্ষিত এবং উচ্চবিত্তের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বেশি।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কানাডার প্রধানমন্ত্রীর কথা, এক সময়ের পৃথিবীর শীর্ষ ধনী বিল গেটসের কথাও। একইভাবে পৃথিবীর আরেক শীর্ষ ধনী ইলন মাস্কের জীবনেও বিয়েবিচ্ছেদ ঘটেছে। অথচ অর্থ, বিত্ত, আভিজাত্যের কোনো অভাব এসব ব্যক্তির জীবনে ছিল না। চলচ্চিত্র জগতের নায়ক-নায়িকাদের মধ্যেও বিয়েবিচ্ছেদ অনেক বেশি।
একটি ছেলে ও এটি মেয়ে যখন বিয়ে করে তখন নতুন একটি সংসার গঠনের পাশাপাশি দুই পরিবার ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেও সুসম্পর্ক এবং বন্ধন গড়ে ওঠে। সংসারজীবন স্থায়ী হলে এসব সম্পর্ক স্থায়ী হয়, যা মানুষের জীবনকে সুন্দর ও আনন্দময় করে তোলে।
অন্যদিকে সংসারজীবনে বিচ্ছেদ হলে স্বামী-স্ত্রীর পাশাপাশি দুই পক্ষের পরিবারের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তাও ভেঙে যায়। আর পরিবারের সন্তানদের জীবনে যে অনিশ্চয়তা, বিচ্ছিন্নতা ও মানসিক যন্ত্রণার কারণ ঘটে তা বর্ণনাতীত। একটি সংসার যখন ভেঙে যায়, তখন সংসারের দু’টি মানুষই একা হয়ে যায়। একাকী জীবন কখনো সুখের হয় না। তাদের জীবন গ্রাস করে হতাশা, বিষন্নতা ও দুশ্চিন্তা।
মানসিকভাবে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। বিচ্ছেদ উভয়ের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আর সংসার ভাঙলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। তারা যৌথ সংসার থেকে বঞ্চিত হয়, একই সাথে বাবা-মার ভালোবাসা, স্নেহ মমতা এবং গাইডেন্স থেকেও বঞ্চিত হয়। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ কোমলপ্রাণ শিশুর মনে অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারা হতাশা এবং হীনম্মন্যতায় ভোগে। তারা সবসময় একটি পরিচয় সঙ্কটে ভোগে। ফলে দেহ ও মনের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়। ভাঙা পরিবারের সন্তানরা আজীবন দুঃখের বোঝা বয়ে বেড়ায়। সুতরাং সবার উচিত সংসার টিকিয়ে রাখা, টেকসই ও মজবুত করা। তার জন্য প্রয়োজন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস, ত্যাগ, ভালোবাসা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সমঝোতা।
স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের প্রধান কারণ বনিবনা না হওয়া। বনিবনা না হওয়ার জন্য সচরাচর যেসব অভিযোগ ওঠে তার মধ্যে অন্যতম- স্বামীর অবাধ্যতা, অশালীন জীবন যাপন, বদমেজাজ, শ্বশুর পক্ষের লোকজনকে কম ভালোবাসা, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, পরকীয়া, সন্দেহজনক মনোভাব, যৌতুক দাবি, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন ইত্যাদি। এসব পরিহার করা অসম্ভব নয়। সংসার টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই সবার উচিত এসব কাজ পরিহার করা।
সংসারের স্বার্থে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ পরিহার করুন। পরস্পরের ছোটখাটো দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করুন। মান অভিমান, অহমিকা, জেদাজেদি ও রেষারেষি পরিহার করুন। স্ত্রী কর্মজীবী হলে তাকে একটু বেশি সহযোগিতা করতে হবে। কারণ সংসার ও সন্তান লালন পালনের দায়িত্ব তখনো তাকেই পালন করতে হয়। স্বামীসহ ছেলেপক্ষের সবার উচিত স্ত্রী বা মেয়ের প্রতি একটু সহানুভূতিশীল হওয়া, তার প্রতি একটু কোমল আচরণ করা এবং তাকে একটু বেশি সম্মান করা। কারণ মেয়েটি কিন্তু তার বাবার বাড়ি, পিতা-মাতা, ভাইবোন, পরিচিত পরিবেশ, যেখানে সে জন্মগ্রহণ করেছে এবং যেখানে সে বড় হয়েছে, তার সবই ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে এসেছে। সুতরাং আপনার বাড়িতে আসা মেহমানকে সম্মান করুন।
চারদিকে যখন সংসার ভাঙার নেতিবাচক খবর শুনি, তখন কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী দাম্পত্য জীবনের ইতিবাচক খবরও আমরা পাই। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ দাম্পত্য জীবন আমৃত্যু অটুট রাখেন ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে। যারা ধর্ম অনুসরণ করেন না তাদের দাম্পত্য জীবন ধর্মপ্রাণদের তুলনায় স্বল্পস্থায়ী। এটি প্রমাণিত সত্য।
সুতরাং সবারই উচিত নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা। অর্থ-সম্পদ, সফলতা-ব্যর্থতা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সবই জীবনের অংশ। ঠুনকো অজুহাতে সংসার না ভেঙে দাম্পত্য নামক গাছটিকে দীর্ঘস্থায়ী এবং মজবুত করে গড়ে তোলার চেষ্টা করুন।
স্বামী-স্ত্রী যদি সংসার টেকানোর সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে সেটি কেউ ভাঙতে পারবে না। সুতরাং সচেতন প্রচেষ্টায়, পারস্পরিক সমঝোতায় সংসার টিকিয়ে রাখুন, আমৃত্যু স্থায়ী করুন। নিশ্চয়ই জীবন সুখময় ও উপভোগ্য হবে। এতেই জীবনের সার্থকতা ও সফলতা।
লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক