৫ ই নভেম্বর ২০২৪, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মার্কিন জনগণ তাদের ৪৭ তম রাষ্ট্রপতিকে চার বছরের মেয়াদের জন্য নির্বাচিত করেছে। ডোনাল্ড জে ট্রাম্প চার বছরের বিরতির পর এখন আবারও পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন। মূলধারার মিডিয়া্ সমুহের মতে একজন ফ্যাসিবাদী এবং অনেক মার্কিন নাগরিকদের নিকট ত্রাণকর্তা হিসাবে বিবেচিত, ট্রাম্প একজন ব্যতিক্রমী রাষ্ট্রপতি যিনি কোনো প্রথাগত রাজনীতিবিদ নন বরং তিনি একজন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রপতি। মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন (MAGA) আন্দোলন বর্তমানে মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির আলোচিত বিষয় এর কেন্দ্রে রয়েছেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের প্রাক্তন প্রধান কৌশলবিদ স্টিভ ব্যাননের মতে, ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন "আমেরিকান রাজনীতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন"। জর্জ ডব্লিউ বুশের পর ২০২৪ সালের নির্বাচনে, ট্রাম্পই প্রথম রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট যিনি একই সাথে পপুলার ভোট এবং ইলেক্টোরাল কলেজ উভয়টিতেই জয়ী হন।
ট্রাম্পের এই পুনরায় আগমন সমগ্র বিশ্বব্যাপী একটি গুরুত্ব বহন করে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ট্রাম্পের আগমনের ফলে এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে কিছু বিশেষ পরিবর্তন আসতে চলেছে, বিশেষত ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন আর চীনের এই অঞ্চলে প্রভাব রোধের জন্য ট্রাম্প প্রশাসন বেশ কিছু নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশা করা যায়। নির্বাচনের পূর্বেই ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছিলেন যে ক্ষমতায় আসলে চীনা পন্যের উপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করবেন। ট্রাম্পের এই ধরনের চীন বিরোধী অবস্থান স্বভাবতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই অঞ্চলে চীনকে মোকাবেলার জন্য ভারতের সাথে সম্পর্ক জোরদারের উপর গুরুত্ব প্রদান করবে। এক্ষেত্রে ট্রাম্পের সাথে হয়ত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সম্পর্ক নতুন উচ্চতা লাভ করবে। আমরা ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের জোরালো প্রয়োগ আশা করতে পারি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ভারতই একমাত্র দেশ যেটি চীনা প্রভাবের বিরুদ্ধে দাড়াতে পারে। সুতরাং আমরা আশা করতে পারি যে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অধীনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে মোকাবেলার জন্য ভারতে প্রচুর বিনিয়োগ করবে। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতে প্রতিরক্ষা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগের আশা করা যায়।
ট্রাম্প প্রশাসনের ভারতের সাথে সম্পর্ক কিন্তু বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করবে। বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বর্তমানে বেশ নাজুক অবস্থানে রয়েছে। এর কারণ হিসেবে আমরা উল্লেখ করতে পারি পূর্ববর্তী সরকারের সাথে ভারতের ঐতিহাসিক উষ্ণ সম্পর্ক যেটি স্বাধীনতার পর থেকেই বিদ্যমান। ৫ই আগস্টের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান এবং বর্তমানে সেখানে অবস্থান করছেন। শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান দুই দেশের সম্পর্কে বেশ টানাপোড়েনের সৃষ্টি করেছে। এমতাবস্থায় ভারতের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো হলে বাংলাদেশকেও কিছু ক্ষেত্রে ভারতের সাথে তাল বজায় রেখে চলতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর বাইডেন প্রশাসনের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক রয়েছে যা নতুন ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। ইউনূস সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ২০২ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০১৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়, ড. ইউনূস হিলারি ক্লিনটনের প্রচারে অনুদান দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়েছিল এবং ট্রাম্প এটি নিয়ে কিছুটা অসন্তুষ্ট ছিলেন কিন্তু একজন ব্যবসায়ী ট্রাম্পের জন্য এটি দুই দেশের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কোন প্রভাব ফেলবে না। কারণ বাংলাদেশ এই অঞ্চলে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির কেন্দ্রবিন্দু নয় বরং মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হবে কিভাবে চীনকে মোকাবেলা করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন মনোভাব বাংলাদেশের জন্য সুবিধা ও অসুবিধা দুটোই বয়ে আনতে পারে কারণ, কারণ চীন বর্তমানে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) মাধ্যমে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। বর্তমানে চীনে ৭.০৭ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ চীনের সাথে তিস্তা নিয়ে যদি অগ্রসর হয় সেটি ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হবে যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ক্ষেত্রেও কিছুটা অস্বস্তির সৃষ্টি করবে।
ট্রাম্পের মেয়াদে আশা করা যায় তিনি 'আমেরিকা ফার্স্ট' নীতির উপর বেশি মনোযোগ দিবেন। তাই প্রশাসনের অন্যান্য বিষয়গুলিতে সীমিত নজর থাকবে এবং প্রধানত অভ্যন্তরীণ স্বার্থগুলিতে ফোকাস করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বিদেশী বিনিয়োগকারী এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রেও তাদের বেশ অবদান রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঔষধ এবং তৈরি পোশাকের একটি বড় রপ্তানিকারক। বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৩ সালে ১৮.০১ মিলিয়নের ডলার মূল্যের ঔষধ রপ্তানি করে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি ১৪% হ্রাসের সম্মুখীন হয়েছে। সুতরাং, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে এ বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে এবং মার্কিন তৈরি পোশাক আমদানিকারদের আস্থা অর্জন করতে হবে।
জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতকে এই তিন পক্ষের সাথেই সু সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেটি করতে পারে সেটি হচ্ছে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা এবং পানি সম্পদ নিয়ে বিভিন্ন প্রজেক্টের দিকে নজর দেওয়া, এর পাশাপাশি চীনের সাথে প্রযুক্তিগত সহায়তাও জোরদার করতে হবে। এমন জটিল পরিস্থিতিতে ভারতের সাথেও একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে কারণ চীনের সাথে ভারতের সম্পর্ক খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই। বাংলাদেশ ভারতের প্রতিবেশী অঞ্চলে তাদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার এবং ভারতের একটি বাংলাদেশকে প্রয়োজন রেল ট্রানজিট এর জন্য। এই ট্রানজিট ভারতকে তার উত্তর-পূর্ব অংশে প্রবেশাধিকার দেবে এবং বাংলাদেশকে ভারতের এই প্রয়োজনকে কাজে লাগাতে হবে। এছাড়া আদানির সাথে বিদ্যুৎ সংক্রান্ত চুক্তি আছে সেটিরও মূল্যায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশ বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নিম্ন বৈদেশিক রিজার্ভ, বৈদেশিক ঋণ এবং নিম্ন রপ্তানির মতো অনেক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এসব সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশকে অবশ্যই বিনিয়োগের জন্য বাজার খুলে দিতে হবে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বিনিয়োগে আগ্রহ তৈরি করবে কারণ মার্কিন বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের তথ্য প্রযুক্তি এবং জ্বালানি খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করতে চায়।
বাংলাদেশ বহু বছর ধরে মিয়ানমার নিয়ে সমস্যার মধ্যে রয়েছে, বিশেষত রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমরা বেশ সমস্যার সম্মুখীন আছি। মিয়ানমার বর্তমানে গৃহযুদ্ধের কবলে রয়েছে এবং বাংলাদেশকে অবশ্যই মিয়ানমারকে, বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যকে স্থিতিশীল করতে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং সেখানে একটি বাজার তৈরি করতে হবে। এটি বাংলাদেশ করতে পারে চীন ও আশিয়ান দেশগুলো আর মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্মিলত প্রচেষ্টার মাধ্যমে যা বাংলাদেশের জন্য একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস হবে। রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রেও কিন্তু বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর সহায়তা আশা করতে পারে।
বাংলাদেশ তার কূটনৈতিক সম্পৃক্ততাকে আরও জোরদার করার জন্য, কোনো একটি নির্দিষ্ট পক্ষের খুব কাছে না গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে। অর্থনৈতিক অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে, বাংলাদেশকে প্রযুক্তি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো বিনিয়োগ-বান্ধব ক্ষেত্রগুলিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে বিদেশী বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া উচিত এবং বাংলাদেশ-ভুটান-ইন্ডিয়া-নেপাল (বিবিআইএন) করিডোরের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে এই অঞ্চলে নিজেকে কৌশলগতভাবে অবস্থান করা উচিত। ভারতের সাথে ট্রানজিট চুক্তি। এর সাথে তৈরি পোশাক খাতে প্রতিযোগীতা উন্নত করার জন্য দেশীয় মান বৃদ্ধির সাথে সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হারানো খ্যাতি পুনরুদ্ধার করার পাশাপাশি রপ্তানির বাজারকে প্রসারিত করতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশকে অবশ্যই বিভিন্ন কূটনৈতিক ও অন্যান্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে মিয়ানমারের স্থিতিশীলতার লক্ষ্য রাখতে হবে এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য অন্যান্য দেশের সাথে কাজ করতে হবে এবং ভূ-রাজনৈতিক নিরাপত্তা বজায় রাখতে এবং তার আর্থ-সামাজিক চাপ কমাতে রাখাইন রাজ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন বৈশ্বিক রাজনীতিকে নতুন সমীকরণের সৃষ্টি করবে। তবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব একটা পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের জন্য ট্রাম্প একটি সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ উভয়ই হতে পারে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি ভাল ভূ-কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে এবং এই অবস্থানটি ব্যবহার করে তার জাতীয় স্বার্থের দিকে মনোযোগ দেওয়া এবং সেটি বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। বাংলাদেশকে অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। ভারত, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখা নিশ্চিত করবে যে এই পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়