গত ১৫ বছরের দুঃশাসন, দুর্নীতি এবং বিরোধী মতের নিপীড়নের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সরকার হঠাৎ করেই জুলাই মাসে এসে মারাত্মকভাবে হোঁচট খায়। ১ জুলাই ২০২৪ এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র/ছাত্রীরা চাকুরির কোটা সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়ে মহামান্য আদালতের একটি রায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং আন্দোলনে মাঠে নামে। এতে খোদ প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বেশ কয়েকজন অর্বাচীন নেতাদের লাগামহীন বক্তৃতা এবং অবজ্ঞায় তা ক্রমান্বয়ে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে এবং সারা দেশের সকল স্কুল কলেজে ঐ আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ছাত্রদের সাথে দেশের নিপীড়িত সকল শ্রেণি পেশার মানুষও যোগ দেয়, ফলে ঐ আন্দোলন ছাত্র-জনতার সার্বজনীন আন্দোলনে রূপ নেয়। ফলে ৫ই আগস্ট ২০২৪, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হয় এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে যায়। উল্লেখ্য, এই আন্দোলনে কম করে হলেও ৮০০ থেকে ৯০০ কোমল মতি ছাত্র/ছাত্রী, সাধারণ জনতা, রিকশাওয়ালা, সাংবাদিক এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী শহিদ হন এবং প্রায় ১৮ হাজারের বেশী ছাত্র-জনতা আহত হয়, যারা এখনও চিকিৎসাধীন আছে। এদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশংকাজনক। তাদের এই আত্মত্যাগ নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাব না।
শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকার পতন আন্দোলনের মূল ভুমিকায় ছিল এই প্রজন্মের তরুণ ছাত্রছাত্রীরা, যাদেরকে আমরা বলছি জেনারেশন জেড (Generation Z)। এই জেনারেশন জেড বা জেন জি, মূলত যারা ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মেছে, এমন তরুণদেরকে বুঝায়। এই প্রজন্ম একটি প্রযুক্তিগতভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও দ্রুত পরিবর্তনশীল সামাজিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছে। এদের মনস্তাত্ত্বিক এবং তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি আগের প্রজন্ম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এরা বর্তমান প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল দক্ষতার সাথে খুব স্বাভাবিকভাবে মিশে গেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের যে কোন পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে সক্ষম এই প্রজন্ম অধিকতর বহুমাত্রিক চিন্তাভাবনা করে। তারা লিঙ্গ বৈষম্য, জাতিগত ভেদাভেদ এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে আগের প্রজন্মের তুলনায় অনেক বেশি উন্মুক্ত ও গ্রহণযোগ্য। ফলে তারা সামাজিক ন্যায়বিচার, বৈষম্যহীনতা এবং বৈচিত্র্যের প্রচার ইত্যাদিতে তারা যথেষ্ট সক্রিয়, যা সমাজকে আরো সমতাভিত্তিক করে তুলতে সক্ষম। এই প্রজন্মের শিক্ষার ধরন এবং মনস্তাত্ত্বিক উন্নতি তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে অনেক শক্তিশালী করেছে। তারা সমস্যার সমাধানে নতুন এবং সৃজনশীল পদ্ধতি ব্যবহার করে সমাজে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে এবং উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। তাছাড়া, পরিবেশগত সমস্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়েও জেনারেশন জেড অত্যন্ত সচেতন। তাদের সচেতনতা এবং সক্রিয়তা সমাজে টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সার্বিকভাবে, জেনারেশন জেড-এর উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা বর্তমান সমাজকে ভবিষ্যতে একটি সমৃদ্ধ, উদ্ভাবনী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম।
অপরদিকে, জেনারেশন জেড-এর ইন্টারনেট এবং মোবাইল প্রযুক্তিতে উচ্চমাত্রার সংযুক্তি, উদ্বেগের কারণ বলে অনেকে মনে করেন। তবে, এটি সমাজের সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রাখতে সাহায্য করতে পারে। যেমন জেনারেশন জেড গ্লোবাল কানেক্টিভিটির সুযোগ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ এবং শেয়ার করে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করাসহ বিভিন্ন সংস্কৃতি, ধারণা ও অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ভবিষ্যতে দেশের মধ্যে সমতাপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সমাজ গঠনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। এছাড়াও, তারা অসাধারণভাবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনলাইনে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে জ্ঞান অর্জন এবং নিজেদের ভাবনাচিন্তা ও উদ্ভাবনী ধারণাগুলো শেয়ার করে বৈশ্বিক সম্প্রদায়কেও সমৃদ্ধ করতে সহায়তা করতে পারে। বর্তমানে তারা মোবাইল অ্যাপস, গেমস, ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং ক্রিয়েটিভ কনটেন্ট এবং অন্যান্য ডিজিটাল টুলসের মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা, সক্রিয়তা, উদ্যোক্তার মানসিকতা এবং ইনোভেশন ও ক্রিয়েটিভ চিন্তাভাবনার প্ল্যাটফরম তৈরি করতে শিখেছে, যার মাধ্যমে তারা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত আন্দোলনে অংশগ্রহণসহ অন্যান্যদেরকে সচেতন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অধিকন্তু, ইন্টারনেট এবং অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলের ব্যবহার, জেনারেশন জেডকে প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ, জ্ঞানবহুল এবং উদ্ভাবনী করে তুলছে, যা সমাজকে ভবিষ্যতে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সহায়ক হবে।
এই জেনারেশনকে নিয়ে আরও একটি অভিযোগ রয়েছে, সেটা হল এরা ভিডিও গেম খেলা এবং মোবাইল ব্রাউজিং মাধ্যমে তাদের দৈনন্দিন জীবনের একটা বড় অংশ ব্যয় করে। তাদের এই আসক্তির একটি ইতিবাচক দিকও রয়েছে, তা হলো, অনেক ভিডিও গেম স্ট্র্যাটেজিক চিন্তাভাবনা, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা উন্নত করাসহ হার না মানার মানসিকতা তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, রোল-প্লেয়িং গেম (RPG) বা স্ট্র্যাটেজি গেমস খেলার মাধ্যমে তরুণরা জটিল সমস্যার সমাধান করার কৌশল শিখছে, যা ভবিষ্যতে, বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলো সমাধানে কাজে লাগতে পারে। এছাড়াও, ভিডিও গেমস খেলার মাধ্যমে অনেক তরুণ ইউটিউব, টুইট এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হিসাবে কর্মজীবন গড়ে তুলছে। গেমিং কমিউনিটি এবং ই-স্পোর্টসের মাধ্যমে তরুণরা আয় করতে পারছে, যা ডিজিটাল ইকোনমিতে নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। মাল্টিপ্লেয়ার গেমগুলোতে খেলোয়াড়দের একসাথে দলবদ্ধভাবে কাজ করতে হয়, যা দলগত দক্ষতা ও যোগাযোগের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও, অনলাইন গেমিং প্ল্যাটফর্মে আলোচনা ও মতামত বিনিময়ের মাধ্যমে তারা কীভাবে একে অপরের সাথে কার্যকরীভাবে যোগাযোগ করতে পারে তা শিখছে। ভিডিও গেম খেলা এবং মোবাইল ব্রাউজিং শুধু বিনোদন নয়; এগুলো জেনারেশন জেড-এর জন্য সৃজনশীলতা, দক্ষতা এবং সামাজিক সংযুক্তি বৃদ্ধির একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে। সর্বোপরি, যা ভবিষ্যতে সমাজের গঠনমূলক পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের জুলাই ও আগস্ট মাসের সরকার পতনের আন্দোলনে জেনারেশন জেড (Gen Z) এর ভূমিকা ছিল সব চাইতে বেশী। তারই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত করে, যা ক্রমান্বয়ে সরকার পতনে ১(এক) দফার আন্দোলনে রূপ নেয়। এই আন্দোলনে নিরস্র ছাত্র ছাত্রীরা ভ্যানগার্ড হিসেবে সম্মুখ সারিতে থেকে পতিত সরকারের পোষা গুন্ডা বাহিনী পুলিশ লীগ, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, হেলমেট লীগদের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করেছে। সম্মুখ যুদ্ধের পাশাপাশি, জেনারেশন জেড এর অনেকে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, এবং টিকটক ব্যবহার করে আন্দোলনের স্বপক্ষে সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের পোস্ট, ভিডিও, এবং লাইভ স্ট্রিমের মাধ্যমে আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য এবং আদর্শ সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের সৃষ্ট সরকারবিরোধী নানা স্লোগান, মিম, এবং ভিডিও ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে। জেনারেশন জেডের যে বড় অংশটি রাস্তায় নেমে আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে, তাদের মধ্যে শিক্ষার্থী ও তরুণ কর্মীরা ছিল উল্লেখযোগ্য। তারা বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন, এবং স্লোগান দিয়ে তাদের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করেছে। এই আন্দোলনের ভিতর দিয়ে অনেকেই নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছে, যা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। সার্বিকভাবে, জেনারেশন জেড বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে তাদের উদ্ভাবনী, সৃজনশীল এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে হার না মানার মানসিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে সরকার পতনের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে যা গত ১৫ বছরে তথাকথিত রাজনৈতিক দল গুলো করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই সরকার পতনের এই আন্দোলনের সিংহভাগ কৃতিত্ব সাধারণ ছাত্র জনতার প্রাপ্য।
অপরদিকে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের গতানুগতিক রাজনৈতিক দল গুলো সরকার পতনে সফল আন্দোলন করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর মত একটি বড় এবং পোড় খাওয়া পরীক্ষিত রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে এটা ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য। যদিও, এই ব্যর্থতার পিছনে অনেক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে বিএনপির অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব একটা বড় সমস্যা। বিশেষ করে, বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় দণ্ড দিয়ে কারাগারে প্রেরণ এবং তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে দেশান্তরিত করে বিএনপিকে নেতৃত্ব শূন্য করার প্রচেষ্টা ছিল অন্যতম। ফলে দলের প্রধান নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সক্রিয় রাজনীতিতে অনুপস্থিতি, অপরপক্ষে জনাব তারেক রহমানের দেশের বাইরে থাকার কারণে দলীয় নেতৃত্বে তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সরাসরি অংশগ্রহণ করতে না পারায়, দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এতে সকল পর্যায়ে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে। এমনকি বিএনপির আন্দোলনগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৌশলগত দুর্বলতা দেখা গেছে। ফলে দল হিসেবে বিএনপি জনসাধারণের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে।
এছাড়াও, গত ১৫ বছরে স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকার বিরোধী মতের নেতা কর্মীদের গ্রেপ্তার, মামলা, গুম-খুন, ইত্যাদি বিভিন্ন কায়দায় নিপীড়ন ও নির্যাতন অব্যাহত রাখায়, বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো ব্যাপকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠনের সংহতি এবং নেতৃত্বের অভাব দেখা দেয়, যা আন্দোলনগুলোকে সফলভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে, দলের কর্মীরা অনেক সময় দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে এবং সঠিকভাবে মাঠে নামতে পারেনি। একই সাথে, দলীয় অনেক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা এবং গ্রেপ্তারের হুমকি থাকায় দলের মনোবলকে আরও দুর্বল করে দেয়, যা বড় ধরনের আন্দোলন সংগঠনে বাধা হিসেবে দেখা দেয়। বিএনপি ২০০৯ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়গুলোতে বিকল্প কৌশল চিন্তা না করে কেবল আন্দোলনের মাধ্যমেই রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছে। এতে, সরকার বিরোধী আন্দোলনে সকল দল ও শ্রেণি পেশার মানুষদেরকে সম্পৃক্ত করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার মতো পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। অনেকের মতে, দলটি ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ভুল কৌশল প্রয়োগ করেছিল, যা তাদের রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করেছে। যদিও ২০২৪ সালের নির্বাচনের পূর্বে দেশের সকল বিভাগীয় শহরগুলিতে আয়োজিত সম্মেলনে তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক জনসমাগম হয়, সর্বশেষ ২৮ অক্টোবর ২৩ এ ঢাকার আয়োজিত মহাসম্মেলনেও সমসাময়িককালের মধ্যে সবচেয়ে বেশী জনসমাগম হয়, তবে ঐ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পাওয়ার আগেই ডিবির বিখ্যাত ডিআইজি হারুনগংদের অপারেশনে অল্পতেই তা ব্যর্থ হয়ে যায়, ফলে দল তাৎক্ষণিকভাবে বিকল্প কর্মসূচি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় জানুয়ারি ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের আমি-ডামির নির্বাচন নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হয় এবং স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা পুনরায় ক্ষমতায় আসিন হয়। বিএনপি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও পর্যাপ্ত সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ছাড়া বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধন করা কঠিন। তবে এই ক্ষেত্রে বিএনপি তেমন কোনো কার্যকর কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এই সবকিছু মিলিয়ে বিএনপির গত ১৫ বছরের রাজনৈতিক আন্দোলনের সফল হতে পারেনি।
তবে ৫ আগস্ট ২০২৪ এর পরে বাংলাদেশের পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকার কেমন হবে তা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। ছাত্র জনতার আন্দোলন পরবর্তী সকল শ্রেণি পেশার মানুষের গণদাবী একটাই, তা হল রাষ্ট্র সংস্কার করা। সেক্ষেত্রে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গৃহীত সকল সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করার পরেই কেবল সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠিত হতে হবে। সেই ক্ষেত্রে আগামীর সরকার ব্যবস্থা তারুণ্য নির্ভর হবে নাকি গতানুগতিক রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে গঠিত হবে, তা নির্ভর করছে বেশ কিছু প্রভাবক বিষয়ের উপর। যদিও তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবে এটাই একমাত্র নিয়ামক নয়। সরকার গঠনে সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিম্নরূপে দেখা যেতে পারে:
১। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে জেনারেশন জেড এবং মিলেনিয়ালরা, রাজনীতিতে আগ্রহী এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়। তারা রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি জানাচ্ছে, নতুন নেতৃত্ব চাইছে, এবং অনেক ক্ষেত্রে পুরোনো রাজনীতির সাথে বিরোধিতা করছে। তরুণরা উন্নয়ন, স্বচ্ছতা, এবং ভালো শাসন ব্যবস্থা চায়। যদি এ প্রজন্মের ভোটাররা বড় কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনের পথে এগিয়ে আসে, তাহলে তারুণ্য নির্ভর নতুন দল বা জোট ক্ষমতায় আসতে পারে। তবে এজন্য একটি সংগঠিত ও কার্যকর রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের দরকার হবে, যা এখনও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান নয়।
২। তাছাড়া বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রভাব, তার কার্যকলাপ ও নীতির ওপরও নির্ভর করছে পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকার কেমন হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনার ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষমতা বিবেচনায় রেখে তারা একটি নতুন বা পুরোনো শক্তিশালী দলকে সুবিধা দিতে পারে। এক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকাকে বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হবে।
৩। তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক কাঠামো এখন অনেকটাই দুই প্রধান দল—আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি’র ওপর নির্ভরশীল। এই দলগুলো তাদের প্রতিষ্ঠিত সংগঠন এবং নির্বাচনী কৌশলের মাধ্যমে দেশীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। তাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং দুর্বলতা সত্ত্বেও, তারা ভোটারদের বড় একটি অংশকে ধরে রাখতে সক্ষম। তবে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে অতি পুরোনো হলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এর বর্তমান গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আপামর জনগণের আপত্তি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এই ক্ষেত্রে বিএনপি এবং অন্যান্য ছোট দলের মধ্যে জোট গঠনের মাধ্যমেই ভবিষ্যতের সরকার গঠনে মূল ভূমিকা রাখতে পারে, সেই সম্ভাবনাকেও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিতে হবে।
৪। যদি তরুণদের নেতৃত্বে একটি নতুন বা বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি উঠে আসে এবং তা জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারে, তাহলে তা ভবিষ্যতের সরকার গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমানে এমন কিছু ছোটখাটো নতুন দল বা জোট আছে যারা নিজেদেরকে পুরোনো দলের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে, কিন্তু তাদের গ্রহণযোগ্যতা এখনও স্পষ্ট নয়। তাই তরুণ প্রজন্ম সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করতে চাইলে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার মত জন সমর্থন অর্জন করতে হবে। তবে এ জন্য একটি স্থিতিশীল, সংগঠিত এবং জনপ্রিয় নেতৃত্বের প্রয়োজন হবে, যা জুলাই আগস্ট আন্দোলনের মাধ্যমে উঠে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, কিন্ত তাদেরকে নার্সিং এবং মেন্টরিং করে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় করতে এবং নেতৃত্বের মানসিকতা গড়ে তুলতে একটি ইনটেলেকচুয়াল প্ল্যাটফরম খুবই জরুরি যা বর্তমানে অভাব রয়েছে।
সুতরাং, ভবিষ্যৎ সরকার তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে গঠিত হবে নাকি গতানুগতিক রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে হবে, তা নির্ভর করছে তরুণদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, নতুন শক্তি গঠনের উদ্যোগ, এবং পুরোনো দলগুলোর কৌশলগত অবস্থানের ওপর। এক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকাও বিশেষভাবে বিবেচনা করা দরকার বলে আমি মনে করি। সকলকে ধন্যবাদ।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল