সৈয়দ জাফরান হোসেন নূর: গণতন্ত্রহীন সমাজে সংবাদপত্রের জন্ম। পক্ষপাতহীনভাবে সময়ের সাথে চলমান ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরে বলেই সংবাদপত্রকে সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্পণ বা আয়না বলা হয়। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও মানবিক চেতনা বিকাশের কেন্দ্র এবং নীতি-নৈতিকতা, দায়-দায়িত্ব ও বুদ্ধি-বিবেকের আধার হচ্ছে সাংবাদিকতা। তাই বলা যায়, গণসচেতনতার জায়গাও সাংবাদিকতা।
সাংবাদিকতা হল বিভিন্ন ঘটনাবলী, বিষয়, ধারণা, মানুষ, প্রকৃতি, পরিবেশ, সমাজ, রাষ্ট্র সম্পর্কিত প্রতিবেদন তৈরি ও পরিবেশন, যা উক্ত দিনের প্রধান সংবাদ এবং তা সমাজে প্রভাব বিস্তার করে। এই পেশায় শব্দটি দিয়ে তথ্য সংগ্রহের কৌশল ও সাহিত্যিক উপায় অবলম্বনকে বোঝায়।
পৃথিবীতে সম্মানজনক পেশাগুলোর মধ্যে সাংবাদিকতা অন্যতম। সাংবাদিকতার মাধ্যমে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে তার মানবিক মূল্যবোধের উপর দাড়িয়ে থাকতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যায় সাংবাদিক। তাই সংবাদপত্র সংশ্লিষ্ট সবার অন্যতম দায়িত্ব সমাজের প্রত্যেককে স্বার্থ সচেতন রাখা।
সংবাদপত্রে সমকালীন বিশ্বের চলমান গতি-প্রকৃতি, ঘটনাপ্রবাহ, জীবনচিত্র ও দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন-অগ্রগতি, সত্য-সুন্দর এবং ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠায় সংবাদপত্রের ভূমিকা অপরিসীম। এজন্যই এডমন্ড বার্ক ব্রিটিশ পার্লামেন্টের গ্যালারিতে উপস্থিত সংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে রাষ্ট্র কাঠামোতে সংবাদপত্রের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা বোঝাতে সংবাদপত্রকে ‘ফোর্থ স্টেট’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
অপরদিকে সাংবাদিকতা হচ্ছে - ঝুঁকিপূর্ণ এবং সাহসী, সংবেদনশীল ও নির্মোহ, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ, সত্যনিষ্ঠ ও গণসম্পৃক্ত সার্বক্ষণিক পেশা। সংবাদপত্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য- দল নিরপেক্ষ সত্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা। সংবাদপত্র যতবেশি নিরপেক্ষ হবে এবং সাংবাদিকরা যত বেশি নির্ভীক ও সৎ হবে দেশ ও জাতির তত বেশি মঙ্গল হবে। আর এজন্যই সাংবাদিকদের বলা হয় সমাজের অতন্দ্র প্রহরী বা ‘গেট কিপারস’।
সংবাদপত্রের এসব বৈশিষ্ট্য আভিধানগতভাবে হলেও অনেক সংবাদপত্র ও সাংবাদিক বিভিন্ন স্বার্থে উল্টাপথে চলেন বা অপসাংবাদিকতায় মত্ত হয়ে ওঠেন, এমন প্রমাণের অভাব নেই আজ।
গণতন্ত্রহীন সমাজে সংবাদপত্রের জন্ম হওয়ায় সংবাদপত্রের দায়িত্ব ছিল সমাজকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত করতে মানুষকে স্বার্থ সচেতন করা ও তাদের আশা-আকাঙ্খাকে তুলে ধরা। পাশাপাশি মানবিক চেতনাবোধকে জাগ্রত করা। তবে যুগের পরিক্রমায় পাশ্চাত্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কম-বেশি গণতন্ত্র আজ প্রতিষ্ঠিত। তবুও অনেক দেশেই আজও অধরা গণতন্ত্র। আবার কোথাও কোথাও গণতন্ত্রের ছায়া এবং মুখোশের আড়ালে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা এখনও লড়াই করে যাচ্ছেন।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোতে সংবাদপত্র স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করতে পারলেও, অগণতান্ত্রিক, বিপর্যস্ত কিংবা স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় সংবাদপত্রের যথাযথ ভূমিকা পালন করা খুব কঠিন। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকের দায়িত্ব সেখানে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। গণতন্ত্রকামী জনগণের পাশাপাশি গণতন্ত্রের জন্য আপোষহীনভাবে গণমাধ্যমকেও লড়াই করতে হয়।
এজন্যই সাংবাদিক ও তার হাউজকে নানা ঝুঁকি নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। এ সময় সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের নাগরিক অধিকার এবং মানবতার পক্ষে অবস্থান নিতে গিয়ে স্বৈরশাসক বা শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়।
স্বৈরসরকার বিরোধিতা রাষ্ট্র বিরোধিতা না হলেও, স্বৈরশাসকরা কৌশলে রাষ্ট্রকে সংবাদপত্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়। তখন গায়ে পড়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সরকারের বিরোধিতা না করে গঠনমূলক কাজের প্রশংসা করা নিরপেক্ষ সংবাদপত্রে কর্তব্য। এসময় জাতীয় স্বার্থে সরকারের নীতি ও কাজের সমর্থন দেয়া সংবাদপত্রের দায়িত্ব।
আজ গণমানুষের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের দায়িত্বের দিকে তাকালে স্পষ্টতই দেখা যায়- সাংবাদিকতা রাজনীতি, রাজনৈতিক দল, করপোরেট হাউস ও বিভিন্ন আদর্শিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং প্রশ্নবিদ্ধ। অর্থনৈতিক নানা গতি-প্রকৃতির হাতের মুঠোয়। ফলে,গণমানুষের সংবাদপত্র চিন্তার অনৈক্য, সঠিক বুঝ বিবেচনার অভাবে পথ হারাচ্ছে গণমুখিতা। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে গণমুখী সাংবাদিকতা। এরজন্য অবশ্য বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক স্বার্থ ও বাস্তবতা জড়িত।
গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ন বিষয় হচ্ছে-ক্ষমতার ভারসাম্য। যা অন্যায়ের পথকে রুদ্ধ করে ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের অধিকার সুষমভাবে বন্টন করতে সাহায্য করে।
জন্মগতভাবেই সংবাদপত্র গণমুখী, গণমানুষের। মূলত ‘গণজ্ঞাপক’ এক সত্তা হচ্ছে সংবাদপত্র। সকল বস্তু, পেশা ও বাস্তবতাকে মূল্যায়ন করার একটা পরিমাপক রয়েছে। এদিক থেকে সংবাদপত্রকে মূল্যায়ন করার পরিমাপক হচ্ছে প্রচারসংখ্যা। অর্থাৎ প্রচারসংখ্যা বা সার্কুলেশনের ভিত্তিতে সংবাদপত্রের গ্রহণযোগ্যতা বা গণগ্রাহ্যতা পরিমাপ করা যায়।
কিন্তু খুবই পরিতাপের ও হতাশার বিষয় হচ্ছে- আজ সংবাদপত্রগুলোকে সরকার বা নিয়ন্ত্রিত সংস্থাকেন্দ্রিক যে পরিমাণ প্রচারসংখ্যা বা সার্কুলেশন নির্ধারণ করে দেওয়া হয় তা কোনো সংবাদপত্রই মানেন না বা ছাপানো হয় না। ফলে, সংবাদপত্র হারাচ্ছে গণমুখীতা এবং বঞ্চিতদের অভিযোগ-কান্না নিরবেই মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে।
সংবাদপত্রের আবির্ভাবের কারণে সরকারের পক্ষ থেকে নাগরিকদের বিধিনিষেধ, আইনকানুনের মান্য-অমান্যতা এসব বিষয়ের লিখিত প্রয়োজনীয়তা সমাজ বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় একমুখী প্রক্রিয়া থেকে এখন দ্বিমুখী কিংবা বহুমুখী হয়ে উঠেছে । আগে সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের স্থান ছিল না, সুযোগ ছিল না, এখন মত প্রকাশের জায়গা তৈরি হয়েছে। যাকে বলতে পারি ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’।
সংবাদপত্র শব্দের আরেক অর্থ হচ্ছে গণমানুষ। যেখানে থাকবে সব শ্রেণী-পেশার জনসাধারণের সম্পৃক্ততা। অনিবার্য এই ‘গণসম্পৃক্ততা’ ছাড়া কোনো ‘ছাপা কাগজ’কে নিছক লিখিত কাগজ বলা যাবে। কিন্তু, সংবাদপত্র বলা যাবে না।
অপরদিকে সংবাদপত্রে কর্মরত পেশাজীবী সাংবাদিক সেই জনসাধারণের প্রতিনিধি। যাকে গণমানুষের সুখ-দুঃখ-বঞ্চনা, অধিকারহীনতা এবং অধিকার বোধকে ধারণ করতে হয়। তাই আপামর জনতার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, প্রত্যাশা-বঞ্চনাকে তুলে ধরা এবং গণতান্ত্রিক সমাজকে জবাবদিহির মধ্য দিয়ে মানবীয় করে তোলাই একজন সাংবাদিকের দায়িত্ব।
একজন শাসকের দায়িত্ব রাষ্ট্রে সুশাসন নিশ্চিত করা। সঠিকভাবে কর্তব্য পালনের মাধ্যমে এই দায়িত্ব যথাযথ ও ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে। কর্তব্য পালনের ভার যাদের ওপর অর্পিত হয়, তারা যদি সেটা সঠিকভাবে পালন করতেন, তা হলে নিপীড়ন-নির্যাতনের উদ্ভব ঘটত না। সেই ঘাটতি থেকেই জন্ম নেয় অন্যায়। আর এই অন্যায় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানুষকে কথা বলতে হয়। সংবাদপত্র সেই সব সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকেই তার লেখনির মাধ্যমে তুলে ধরেন। এটাই গণমানুষের সাংবাদিকের দায়িত্ব এবং কাজ। যত সহজে কথাগুলো লেখা গেল, বাস্তবতা কিন্তু সমাজে এর ঠিক উল্টোটাও ঘটে এবং ঘটছে।
সংবাদপত্র সত্যকে তুলে ধরে। কোনো স্বার্থের পক্ষ না নিয়ে নিরপেক্ষ ও নির্মোহ রূপে সত্যের পক্ষে দাঁড়ায়। বর্তমানে তা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। কারণ, বর্তমানে নানা মতাদর্শ ও পথের সম্মিলনের পরিবর্তে চলছে বিভিন্ন মতাদর্শ ও নানা পথের ঘূর্ণাবর্ত প্রকাশনার আস্ফালন। এখন সংবাদপত্র আছে বিভিন্ন আদর্শে, রাজনীতি, পেশাজীবী, গোষ্ঠী, ধর্ম এবং ব্যবসায়ীর।
ফলে প্রকৃত স্বার্থের আধারে থেকে যায় প্রকৃত সত্য। আর যখনই ‘সত্য’ খণ্ডিত হয়, ব্যক্তি, শ্রেণি, পেশা এবং গোষ্ঠীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট হয়; তখনই মৃত্যু হয় সত্যের; তখনই প্রকৃত সংবাদপত্রের মৃত্যু ঘটে। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, বর্তমানে গণমানুষের সংবাদপত্রকে এবং সাংবাদিককে দায়িত্ব পালন করতে হলে শুধু নিজের ব্যক্তি স্বার্থের জন্য নয়, সবার স্বার্থ এবং অধিকারকে আদায় করে দেওয়ার কষ্টকর ব্রত নিয়ে পথ চলতে হবে। অবশ্যই পথটা কুসুমাস্তীর্ণ নয়, কণ্টকাকীর্ণই হবে।
আজ সংবাদপত্রের হাইজগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, সরকারের থেকেও হাজারগুন বেশি স্বৈরাচার, আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, লোভী ও অতিমাত্রায় ব্যবসায়িক হয়ে উঠেছে একশ্রেণীর মালিকপক্ষ ও সম্পাদকমহল। তারা বিদেশী ও অবৈধ ক্ষমতাসীনদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়ে নৈতিকতা ভুলে বিভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়নে মত্ত। নৈতিকতা বিচ্যুত, বিপথগামী এই শ্রেনীর হাতে সাংবাদিক ও সংবাদপত্র কুক্ষিগত। ফলে, সত্য আজ বিস্তৃত হতে পারছে না তার আপন গতিতে। পাশাপাশি সাংবাদিকরাও ছুটতে পারছেনা বলগা হরিণের মতো। আবার একশ্রেনীর স্বার্থপূজারী সাংবাদিক রয়েছে যারা গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে হিংসা ও শত্রুতায় মাতাল। এ যেনো কাকের মাংস কাকে খাওয়ার নামান্তর।
একবিংশ শতাব্দিতে আজ পৃথিবী ‘গ্লোবাল ভিলেজে’ পরিণত হয়েছে। সংবাদপত্রও কেবল দেশীয় ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ নেই। প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রেরই মুদ্রিত প্রতিরূপ দেশের পাঠক পড়ে শেষ করার আগে বিশ্বের নানা প্রান্তে অবস্থানরত প্রবাসী পাঠকরা পড়ে শেষ করেন। সংবাদপত্র এবং গণমাধ্যম এমনই সর্বজনীন গণমুখী রূপে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশ্বায়নের এই যুগে গণমুখী সাংবাদিকতার দায়-দায়িত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে প্রত্যাশার চেয়েও বহুগুণ।
লেখক: স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক আমার বাঙলা