হাসান মাহমুদ: ফরাসি স্কুলছাত্র লরেন সোয়াজ। গণিতের পাতা উল্টাতেই হাত-পা ঘেমে একাকার। কোনো অংকের যুক্তির বাদ দিয়ে মুখস্ত করতে বসেও খুব লাভ হয় না। একই অংকের সংখ্যা বা চিহ্ন বদলে দিলেই শেষ। বাবা-মা ভীষণ চিন্তিত।
আপনিও যদি কখনও এমন ভয়ে থাকেন, তাহলে নিজেকে খুব একাকি না ভাবলেও পারেন। গবেষকদের মতে, লরেন সোয়াজের মতো দুনিয়ায় ২০ শতাংশ মানুষ গণিত নিয়ে ভীতির মধ্যে থাকেন। গণিতের ভিতরে থাকা নিগুঢ় যুক্তি মাথায় ঢোকে না। মস্তিষ্ক কাজ করতে অনিহা প্রকাশ করে। কাজ করতে অস্বীকার করে। চরম পরাজয়ের মতো অস্বস্তি বোধ করে।
এবার আসি আসল কথায়, গেল কয়েকদিন দেশের আলোচিত একটি ঘটনার জেরে সামাজিক মাধ্যম কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত। একটি পক্ষের কিছু মানুষ প্রকাশ্যে যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে গণমাধ্যম ও গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর ক্ষিপ্ত। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, ট্রল, এমনকি অশ্রাব্য গালিগালাজ পর্যন্ত থেমে নেই।
যারা মূলত চিকিৎসকদের একটি অংশ, যারা নিজেদেরকে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিত দাবি করে গণমাধ্যমকে তুলোধুনো করছে। ক্ষমতায় পারলে সব গণমাধ্যম বন্ধ করে অথবা না পারলেও নিজেদের লোক ভরিয়ে গণমাধ্যমকে মানুষ বানাতে চায়। পারলে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ইডেন কলেজ শিক্ষার্থী মহবুবা রহমান আঁখি ও তার নবজাতকের মৃত্যুর জন্য গণামধ্যমই দায়ী। গণমাধ্যম খুঁজে খুঁজে রোগী মারার খবরগুলোই প্রকাশ করে।
কিন্তু একটা বিষয় চিকিৎসকদের ওই অংশটির মাথায় কখনও আসে না, ঢাকা মেডিকেলে প্রতিদিন ২০/৫০ লাশ বের হয়। সেখানে বেশিরভাগ টেলিভিশন, পত্রিকার অ্যাসাইন করা রিপোর্টার থাকে। তাহলে প্রতিদিনই তো কম বেশি রোগী মারার নিউজ হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা কি হয়? তাহলে এই যে গণহারে গণামধ্যমকে দায় দেয়া হচ্ছে যে, রোগী মরলেই খবর হয়। এই অভিযোগের ভিত্তি কোথায়?
কোনো সাংবাদিক ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে বসে থাকে না। কখন কোনো রোগী ভুল চিকিৎসার অভিযোগ করবে আর নিউজ করে দিবে। প্রতিদিনই অসংখ্য অভিযোগ আসে, গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে সেগুলোকে দেশের স্বাস্থ্যখাতের স্বার্থে এড়িয়ে যেতেই দেখেছি। বরং যেসব নিউজ হয়, সেগুলোর ব্যাপারে অবশ্যই যৌক্তিক কারণ থাকে। যেগুলো দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের মনে বাজে ধারণা তৈরি করে।
সেন্ট্রাল হাসপাতালের ঘটনায় চিকিৎসকদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ, গণমাধ্যম তৎপর হয়েছে বলেই দুই চিকিৎসককে জেলে যেতে হয়েছে। আর চিকিৎসার নামে যা হয়েছে, সে ব্যাপারে কোনো চিকিৎসকই কথা বলবেন না। তাদের ভাষায় এখানে গণমাধ্যম চিকিৎসা নিয়ে কথা বলতে পারবে না। যদিও কোনো গণমাধ্যই চিকিৎসা নিয়ে কথা বলেন না। অভিযোগ এবং অভিযোগের ব্যাখ্যাই সংবাদের ভিত্তি।
কিন্তু রোগী গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেছে, তার ব্যাখ্যা চিকিৎসক দিতে বাধ্য। যদি ভুল চিকিৎসা বা প্রতারণা না থাকে, তাহলে সৎ সাহস নিয়ে ব্যাখ্যা দিলে সমস্যা কোথায়? যদি চিকিৎসায় কোনো ভুল নাও হয়, তাহলে হাসপাতাল ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক যে প্রতারণা করলো, তার জবার দিবে কে? শুধু এই ঘটনা নয়, এমন হাজারো অভিযোগ আসছে ওই চিকিৎসক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।
এখানে ডা. মিলি জরুরী মহুর্তে চিকিৎসা দিতে এসেছিলেন। তিনিই প্রথম রোগীর স্বজনকে জানান, যে ডাক্তারের অধীনে ভর্তি হয়েছেন, তিনি দেশে নেই। এই ঘটনায় মাহবুবা রহমান বেঁচে থাকলে বা গণমাধ্যম শক্ত ভূমিকা না নিলে কি সিন্ডিকেটের কিছু হতো? হয়তো হতো না, অতীতে যেভাবে রোগীদের ভয় দেখিয়ে তারা পার পেয়ে গেছে, এভাবেই পার পেয়ে যেতেন।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে নূন্যতম চিকিৎসা পেলেও জঘন্য সেবার কারণে দেশের ধনী শ্রেণি দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে শুরু করেছে। সেখানে প্রাইভেট হাসপাতালগুলো মধ্যবিত্তদের ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছিল। সেখানেও হাসপাতালগুলোর অতি মুনাফা লোভী কর্পোরেট মনোভাব আর 'কিছু' চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের মাফিয়া সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে মধ্যবিত্তরাও বহু জায়গায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, প্রতারিত হচ্ছেন।
তেমনি একটি মাফিয়া সিন্ডিকেট ছিল সংযুক্তা সাহা-সেন্ট্রাল হাসপাতাল। যারা কোনো আইন বা নীতির তোয়াক্কা করেননি। বিভিন্নভাবে পার পেয়ে গেছে। এজন্য ১৩ বছর বিএমডিসির রেজিষ্ট্রেশন নবায়ন করার প্রয়োজন মনে করেননি।
দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রয়োজনে চিকিৎসকদের বৃহত্তর স্বার্থেই গণমাধ্যম যথা সময়ে যথা কাজটাই করেছে। ডাক্তার মুনা এবং ডাক্তার মিলির ব্যাপারে সব গণমাধ্যম কর্মীকে পজেটিভ মাইন্ডে কথা বলতে দেখেছি। তাদের মুক্তির ব্যাপারে শুরুতে কোনো চিকিৎসক মুখ খুলতে রাজি হয়নি। গণমাধ্যমকে সর্বোচ্চ এড়িয়ে চলেছেন। মুখোমুখি হতে চাননি। অথচ সোশ্যাল মিডিয়া আর তাদের ইন্টারনাল গ্রুপ গুলোতে একপেশে বিষদাগার করে যাচ্ছিলেন কিছু চিকিৎসক।
গণমাধ্যম তাদের কাছে ধারণা দিয়ে কথা আদায় করতে পারে না, আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় তারাই উল্টো কথা বলে। তাহলে তাদের মধ্যে কি গণিত ভীতির মতো গণমাধ্যম ভীতি কাজ করে? হয়তো অনেকটাই।
একটি পরিবার তাদের দুই সদস্য হারিয়ে নিঃস্ব হলো। ডিউটি ডক্টর মুনা সাহা গ্রেফতার হলো। ডা. মিলি জরুরি কলে চিকিৎসা দিতে এসে মামলার আসামী হয়ে ডিপ্রেশনের চুড়ান্ত পর্যায়ে গেল। এমনকি দুই চিকিৎসককে হাসপাতালে ডেকে এনে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে বলেও শোনা গিয়েছে।
এতে নিজেরা জনরোষ থেকে বেঁচে গেছে। সিন্ডিকেট ডা. সংযুক্তা আর সেন্ট্রাল হাসপাতাল মামলা খেলছে। সেখানে ভুক্তভুগি পরিবারগুলো সন্তান হারিয়ে আর মামলায় বিপর্যস্ত। আর চিকিৎসকের একটি অংশ গণমাধ্যম নিয়ে বিষদগার করেই যাচ্ছে। দুই দিনের ধর্মঘটের পর তাদের সেসব বিষদগার আরও মাত্রা পেয়েছে। এখানেও গণমাধ্যমকে তাদের প্রতিপক্ষ কল্পনা করেছে।
অধিকার আদায়ের হাজারটা পথ, পদ্ধতি আছে। দায়িত্বের সুযোগ নিয়ে কাউকে জিম্মি করা কোনোভাবে নৈতিক হতে পারে না। মটর শ্রমিকদের কাতারে যদি দেশের চিকিৎসকও হয়, তাহলে বলার কিছু নেই। হাসপাতালে ডেকে এনে ডাক্তারকে পুলিশের হাতে তুলে দিল, তখন কথা হলো না। এক প্রেস রিলিজ দিতে দশদিন লাগলো।
আর হটাৎ করে দুই দিনের কর্মবিরতিতে মানুষের যে ভোগান্তি হয়েছে, তাতে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণাই পেয়েছে সাধারণ মানুষ। এজন্য সবার আগে নিজের দায়িত্বশীলতা এবং ওজন বোঝা উচিৎ। না হলে এর সুদূর প্রসারী ফল স্বাস্থ্য খাতকে দুর্বলই করবে।
বিশ্বের নামকরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, গণিতভীতি চিকিৎসা যোগ্য মানসিক সমস্যা। এমনকি কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে দূর হয়। যেমনটি ফরাসি স্কুলছাত্র লরেন সোয়াজ পরবর্তীতে গণিতের সর্বোচ্চ সম্মান ফিল্ডস মেডেলে ভূষিত হয়েছিলেন। তাহলে দেশের মিডিয়া ভয় পাওয়া চিকিৎসকদেরও কি ভীতি দূর করা যেতে পারে। হ্যাঁ, অবশ্যই পারে, শুধু গণামধ্যমের মুখোমুখি হতে হবে।
গণমাধ্যমের প্রশ্নগুলোর উত্তর সাহস করে দিতে হবে। স্বৈরাচারী কায়দায় গালি দিয়ে হুমকি দিয়ে গণামধ্যমের কণ্ঠ রোধ করা যায় না। গণমাধ্যম কারো শত্রু হয় না, কখনও কখনও স্বৈরাচারী এই কায়দা অবলম্বন করে। ইতিহাস সাক্ষী, তারা গণাম্যমের কাছে কখনই টিকে থাকতে পারেনি।
দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। দেশের বাইরে রোগী যাওয়ার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে, সেটি রোধ করতে হলে, অবশ্যই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মাফিয়াদের সিন্ডিকেট ভাংতে হবে। না হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের চিকিৎসকরাই।
তবে দেশের সার্বিক অর্থনীতির কথা চিন্তা করে গণমাধ্যম প্রয়োজনীয় কাজটিই করবে। সেখানে কারো রক্তচক্ষু খুব বেশি কাজে দিবে বলে মনে হয় না। এই সংষ্কারে চিকিৎসকদের সঙ্গে অবশ্যই গণমাধ্যমের দূরত্ব কমাতে হবে।
লেখক:
নিজস্ব প্রতিবেদক, দেশ টিভি