সংগৃহিত
মতামত

অস্বাভাবিক শিলাবৃষ্টি, এখনি সময় পরিকল্পনা গ্রহণের

সৈয়দ জাফরান হোসেন নূর: স্মর‌ণকালের ভয়বহ শিলাবৃষ্টিতে সিলেট অঞ্চলে চল্লিশ জনের অধিক মানুষ মারাত্মভাবে আহত হয়েছেন। চলতি বছরের মার্চ মাসের ৩১ তারিখ (রোববার) দিবাগত রাতে জেলার গোপালগঞ্জ উপজেলায় কালবৈশাখী ঝড়ের সময় শিলাবর্ষণের ঘটনা ঘটে।

ভূপৃষ্ঠে পতিত শিলাখন্ডের আকার ২০০ গ্রামের অধিক বলে স্থানীয়সূত্রে জানা যায়। আহতদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়। চোখে আঘাতপ্রাপ্ত একজনকে সিলেট এম এ জি ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

গত এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ দুপুরে ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল, নেকমরদ, পীরগঞ্জ ও বালিয়াডাঙ্গীতে কালবৈশাখী ঝড় এবং শিলাবৃষ্টিতে কৃষি জমিতে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বিশেষ করে মরিচ, ভূট্টা, আম, লিচুর গুটিসহ আরও অন্যান্য ফসলেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সূত্রে জানা যায়।

অপর এক ঘটনায় গত ১৮ এপ্রিল ভোরে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে কালবৈশাখী ঝড়, বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টিতে বহু ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে কৃষকের ফসলি জমিতে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, শিলাবৃষ্টিতে বোরো ধান, গ্রীষ্মকালীন সবজি, টমেটো ও ডালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ৯৫০ হেক্টর জমির বোরো ধান আক্রান্ত হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে ৪৫ হেক্টর জমির ধান। শুধু বৃষ্টি হলে তেমন ক্ষতি হতো না। শিলা পড়ায় ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে।

উপরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, চলতি গ্রীষ্মকালে কালবৈশাখী ঝড়ের সাথে শিলাবৃষ্টির ঘটনাগুলো জীবন ও জীবিকাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশে শিলাপাতের ঘটনা ভয়াবহ আকারে প্রাণীকূলে আঘাত হানছে। শুধু যে এবছরেই চোখে পড়ার মতো তা নয় বিগত সালগুলোতেও এর চিত্র রীতিমতো বুকে কাঁপন তুলে দেয়। বিগত ২০১৫ সালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় শিলাবৃষ্টিতে পাঁচ হাজারের অধিক পাখি মারা গেছে। এরকম আরো অনেক রেকর্ড আছে।

শিলাবৃষ্টি পরিবেশের একটি স্বাভাবিক নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু পরিবেশ দূষণ ও বিপর্যয়ের ফলে সৃষ্ট জলবায়ূর পরিবর্তনে সময়ের পরিক্রমায় অস্বাভাবিক ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে শিলাবৃষ্টি। যা প্রাণীকূলের উপর স্রষ্টা ও প্রকৃতির পক্ষ থেকে রীতিমতো ভয়ংকর অভিশাপ হয়ে উঠেছে।

সহজ কথায় শিলাবৃষ্টি হচ্ছে বজ্রপাতের সময় কখনও কখনও মেঘ থেকে ঝরে পড়া বরফের ছোট পিণ্ড। বরফের পিণ্ড দিয়ে তৈরি এক ধরনের কঠিন বৃষ্টি। সাধারণত এই বৃষ্টি ১৫ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় না তবে মানুষের ক্ষতি করতে পারে এবং ভবন, যানবাহন এবং ফসলের ক্ষতি করতে পারে।

সাধারণভাবে, আকাশে যখন মেঘের পরিমাণ বেশি হয় বা মেঘ অনেক বেশি ভারি হয়ে ওঠে, তখন বৃষ্টির সময় আকাশ থেকে বরফের টুকরা বা মেঘের কণা পড়ে থাকে একেই শিলাবৃষ্টি বলা হয়ে থাকে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিভিয়ার স্টর্মস ল্যাবরেটরির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, শিলাবৃষ্টি হল কঠিন বরফের সমন্বয়ে এক প্রকার বৃষ্টিপাত। যা বজ্র-ঝড়ের উর্ধ্বমুখী স্রোতের ভেতরে তৈরি হয়।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, চৈত্রের শেষ ও বৈশাখের শুরুতে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা বায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশে কালবৈশাখী হয়। তখন বাতাসে এক ধরনের উর্ধ্বমুখী চাপ সৃষ্টি হয়। সে কারণেই প্রচণ্ড ঝড় হয়। আর এর বৈশিষ্ট্যের মধ্যে দমকা হাওয়া, বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি ও বজ্রপাত রয়েছে। এসময় বাড়িঘর, গাড়ি এমনকি মানুষের মৃত্যুর কারণ ও হতে পারে শিলাবৃষ্টি। এমনটি বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ওই ওয়েবসাইটে।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্টর্মস ল্যাবরেটরির ওয়েবসাইটে বর্ণনা করা হয়েছে, যখন বৃষ্টির ফোঁটা বজ্রঝড়ের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলের অত্যন্ত ঠাণ্ডা জায়গায় ঊর্ধ্বমুখী হয় এবং জমাট বাঁধে তখন শিলাবৃষ্টি তৈরি হয়।

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিলাবৃষ্টির প্রধান শর্ত প্রচণ্ড গরম। বাংলাদেশে চৈত্র-বৈশাখ মাসে এ রকম গরম পড়ে। ফলে মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে যে কালবৈশাখী ঝড় হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই শিলাবৃষ্টি হয়। এ সময় ভূ-পৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুমণ্ডলের কোথাও কোথাও ৩৪ থেকে ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকে। ওই সময় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দখিনা বাতাস আসতে পারে। তার সঙ্গে যোগ হয় বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের তাপীয় লঘুচাপ। একইসাথে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জলীয় বাষ্পে পূর্ণ আর্দ্র বাতাস যুক্ত হয়।

এই দুটির সাথে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা অপেক্ষাকৃত শীতল বাতাসের সংমিশ্রণে মেঘমালা তৈরি হয়। এগুলো ভূ-পৃষ্ঠের তিন কিলোমিটার উপর থেকে আরো ১৮ থেকে ২২ কিলোমিটার পর্যন্ত উপরে উঠে যায়। জলীয় বাষ্প উপরে উঠে আরো ঠাণ্ডা হয়ে যায় এবং ছোট ছোট বরফ কণায় পরিণত হয়। এই ছোট ছোট বরফ কণা আশে পাশের আরও বরফ খণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং শিলা খণ্ডে পরিণত হয়। শিলা খণ্ড যখন বেশি ভারি হয়ে যায় তখন এর ওজনকে আর বায়ুমণ্ডল ধরে রাখতে পারে না। তখন এগুলো শিলাবৃষ্টি আকারে ভূ - পৃষ্ঠে নেমে আসে।

এ কথা স্পষ্ট যে শিলাবৃষ্টির প্রধান কারণ গরম বা উষ্ঞতা। অর্থাৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে শিলাপাতের পরিমাণ ও ঘটনা বাড়বে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় বাংলাদেশসহ বিশ্বে উষ্ঞতা বা তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ও পাচ্ছে। ফলে, অস্বাভাবিক শিলাবৃষ্টির পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধি পরিবেশ বিপর্যয়ের একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া। এর প্রতিক্রিয়া বহুমাত্রিক, অনেক ক্ষেত্রে জীবন বিপন্নকারী। বৈশ্বিক তাপমাত্রা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টির এবং শিলাপাতের মতো অবস্থায় পৃথিবী এক ভয়াবহ পরিবেশ দুর্যোগের কবলে পড়বে।

বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশ বহুমুখী এবং ক্রমবর্ধমান পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে। এর সাথে অতিরিক্ত ঝুঁকি বাড়িয়েছে এর ভৌগোলিক অবস্থান। যদিও বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের অবস্থান পেছনের সারিতে, বার্ষিক কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ প্রায় ১৪০ মিলিয়ন টন; তবু পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে এর অবস্থান সপ্তম।

দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার ঘনত্ব, জমির বিরূপ ব্যবহার, বাধা ও পরিকল্পনাহীন নগরায়ন, দ্রুত মরুকরণ প্রক্রিয়া, অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে বনাঞ্চল ধ্বংস, জলাধার ভরাট, কয়লা, কাঠ, জীবাশ্ম জ্বালানি এই বিপর্যয়কে আরো দ্রুততা দান করেছে। অস্বাস্থ্যকর ইটভাটা এবং মান নিয়ন্ত্রণবিহীন সিমেন্টের উৎপাদন ও ব্যবহার পরিবেশ-বিপর্যয়কে ক্রমেই সবার অগোচরে চরম পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে এখন ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, অস্বাভাবিক শিলাবৃষ্টি ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ও ফসলহানির যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা বিপর্যস্ত পরিবেশের কারণে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি যাই হোক না কেন জার্মান ওয়াচ ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী পরিবেশ বিপর্যয়ে ক্ষতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে রয়েছে।

পরিবেশ বিপর্যয় ঝুঁকির ক্ষতি এড়াতে উদ্যোগ নেয়ার সময় এখনই। যদিও ২০৩০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণ ২১ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনায় অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। পরিবেশ বিপর্যয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা, বিপর্যয়ের ক্ষেত্রগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করার ক্ষমতাসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব পারে কার্বন নিঃসরণকে সীমিত বলয়ে রাখতে।

প্রজন্মের ওপর পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাব সম্পর্কেও রাজনৈতিক নেতাদের সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। এ ব্যাপারে প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকরী সমন্বয়। একই সাথে গণসম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যায় প্রণোদনা, পরিবেশবান্ধব চুলার ব্যবহার কার্বন ফুটপ্রিন্টকে বদলে দেবে নিঃসন্দেহে। একই সাথে যানবাহন শিল্প-কারখানা কৃষি ও দৈনন্দিন জীবনাচার কার্বন নিঃসরণ এবং তা কমিয়ে আনার ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করার ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যাপক উদ্যোগের প্রয়োজন।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট অস্বাভাবিক শিলাপাতের ঘটনা মোকাবেলায় এখনি প্রয়োজন কার্যকর ও সঠিক পরিকল্পনা, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। অপরিকল্পিত বৃক্ষ নিধন রোধ করে পরিকল্পিতভাবে বনায়ণ ও সবুজায়নের মাধ্যমে সুশীতল স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ গ্রহণ।

এ উদ্যোগ গ্রহণে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশে উষ্ঞতা বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় ও শিলাপাতের ঘটনায় ফসলহানি ও মৃত্যু জ্যামিতিকহারে বাড়বে। ক্ষতি হবে অর্থনীতির পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ। মনে রাখতে হবে, প্রকৃতি ছাড় দেয় তবে ছেড়ে দেয় না।

লেখক:

স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক আমার বাঙলা

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

জয়ে ফিরল আর্জেন্টিনা

শেষ মুহূর্তে লাউতারো মার্টিনেজের দুর্দান্ত এক গোলে...

এ আর রহমানের ২৯ বছরের সংসার ভাঙছে

দীর্ঘ ২৯ বছরের সংসার ভাঙছে খ্যাতিমান সঙ্গীতজ্ঞ, অস...

ঝিনাইদহে সুদের টাকা না পেয়ে বাড়ি দখলের অভিযোগ

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে সুদের টাকা না পেয়ে এক দিনমজুরে...

জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে শিল্পকলায় ভাস্কর্য কর্মশালা: পরিচালনায় ভাস্কর পাপিয়া

রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির প্রশিক্ষণ বিভাগের তত্ত্...

গাজায় অর্ধশত ফিলিস্তিনি নিহত, প্রাণহানি ৪৪ হাজার ছুঁই ছুঁই

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে আরো অর্ধ...

আদানির বিরুদ্ধে ঘুষ-প্রতারণার অভিযোগ আনলো যুক্তরাষ্ট্র

বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ভারতীয় ধনী আদানি গ্রুপের চেয়া...

‘ট্রাম্প’ কি শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন!

শেখ হাসিনা এখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কি-না, এ...

মোহিনীর মোহেই কি সংসার ভাঙলেন রহমান?

ভারতের অস্কারজয়ী সংগীত শিল্পী-সুরকার এ আর রহমান ও সায়রা বানু তাদের দীর্ঘ ২৯ ব...

নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ: সরাসরি খেলতে বাংলাদেশের সামনে কঠিন সমীকরণ

আগামী বছর ভারতে অনুষ্ঠিত হবে নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ।...

রাষ্ট্র পুনর্গঠনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ অন্তর্বর্তী সরকার: প্রধান উপদেষ্টা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ছাত্র-জনতার আন্...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা