ছবি: সংগৃহীত
মতামত

বিজয় দিবস বাঙালির শৌর্য-বীর্যের প্রতীক

মুসা সাদিক: আজ মহান বিজয় দিবসের পুণ্যলগ্নে বঙ্গজননীর বুকে কোটি ভাইবোন জেগে উঠুন ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকার উদ্দেশ্যে অভিবাদন জানান। বাঙালি জাতির মুক্তিদূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামে সালাম জানান। ৩০ লাখ শহীদের দেশ বাংলাদেশের পুণ্যভূমিতে ১৬ ডিসেম্বরের পুণ্যময় বিজয়লগ্নে লাখো-কোটি কণ্ঠস্বরে গেয়ে উঠুন বিজযের গান : উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ, যে করিবে দান ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই।

’৭১ সালে আমি তখন প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের অধীনে স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সাথে এক ফ্রন্ট থেকে অন্য ফ্রন্টে উল্কার বেগে চলাচল আমার। দিল্লীর বি বি সি ব্যুরো চিফ মার্ক টালিকে প্রতিদিন মুক্তিযুদ্ধের একটি সফল অপারেশন, একটি পাক সেনাদের টহল জিপ বা ট্রাক ধ্বংসের অথবা খান সেনাদের একটি লঞ্চের ওপর মুক্তিদের একটি রকেট লাঞ্চারের শেল নিক্ষেপের সংবাদ না দিতে পারলে সে রাতে আমার ঘুম হারাম হয়ে যেত। স্বাধীন বাংলা বেতারে বার্তা বিভাগে শ্রদ্ধেয় লোহানী ভাই এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব আনোয়ারুল হক খান অপেক্ষা করে থাকতেন ফ্রন্ট থেকে আমার পাঠানো একটি সফল অপারেশনের খবরের জন্য। তাই যেখানে যুদ্ধ, যেখানে বারুদের গন্ধ, কামানের কান ফাটা শব্দ, সেখানে আমি উল্কার বেগে মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডো অপারেশনের সংবাদের জন্য ছুটে যেতাম। পাক সেনাদের ওপর একটি কমান্ডো হামলার সংবাদ এবং একটি পাক সেনাদের ডিফেন্সে বা বাঙ্কারে একটি গ্রেনেড নিক্ষেপের বা একটি কালভার্ট বা ব্রিজ উড়িয়ে দেবার সাফল্যের সংবাদ আমার চাইই চাই। মনে হতো সমগ্র বাঙালি জাতি, সমগ্র বিশ্ব, আমার সংবাদের জন্য কান পেতে অপেক্ষা করে আছে। তদুপরি, প্রতি সপ্তাহে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে স্বকণ্ঠে আমার প্রচারিত ”মুক্তাঞ্চল ঘুরে এলাম” ও ”রণাঙ্গন ঘুরে এলাম” কথিকা দুটি প্রচারের জন্যও ওয়ার ফ্রন্টের সংবাদ সংগ্রহ করা আমার জীবনের একমাত্র ব্রত হয়ে উঠেছিল। সেজন্য জীবন তুচ্ছ করে ওয়ার ফ্রন্টে বেপরোয়া ছিলাম আমি। বহুবার মুক্তাঞ্চল ভেদ করে পাক সেনাদের অবরুদ্ধ অঞ্চলে ঢুকে গেছি শুধু একটি সংবাদের জন্য ছাড়াও শত্রু এলাকার গোপন সামরিক তথ্য সংগ্রহের যে গুরুদায়িত্ব ছিল আমার ওপর সেজন্যও। তখন সকল মুক্তিযোদ্ধাদের মতো আমার চোখের সামনে সব কিছু ছিল অন্ধকার। সব কিছুই ছিল অনিশ্চিত। শুধু নিশ্চিত ছিল স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার স্বপ্ন চোখে-মুখে এঁকে বহু তরুণ বীর কিশোর আমার চোখের সামনে রণাঙ্গনে রণাঙ্গনে চির নিদ্রায় ঢলে পড়েছে। সেই স্বাধীনতার বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারে ‘৭১-এর তরুণ-কিশোর-যুবকরা তাদের যৌবনের সবটুকু নিঃশেষ করে শত শত রণাঙ্গনে ফুলের মতো যখন ঝরে ঝরে পড়ছিল, তখন জীবন-মৃত্যু দু’পায়ে দলে বহুবার, বহু রণক্ষেত্রে নিঃশব্দে পাক ব্যূহ ভেদ করে চলে যেতাম আমি পাকিস্তানী ঘাঁটি, ডিফেন্সের সামরিক তথ্য সংগ্রহে। দুঃসাহসিক এ রকম বহু সাফল্যের পর অকস্মাৎ আমার জীবনে দুর্ভাগ্য নেমে আসে ৮ নম্বর সেক্টরের চাঁচড়ায়। যখন আমার জীবন-মৃত্যুর ব্যবধান ছিল ১ সুতার ব্যবধান মাত্র। মুক্তিযুদ্ধের জন্য জীবন বিলিয়ে দেবার সেই পুণ্যময় দিনগুলোর ঘটনার বিষয়ে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন ”পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে তাঁকে স্বাধীন বাংলা বেতারের সমর সংবাদদাতা নিয়োগ করা হয়। সংবাদদাতার কাজের পাশাপাশি ফ্রন্টে পাক পজিশন ও ডিফেন্সের তথ্য সংগ্রহের সামরিক গুরুত্বপূর্ণ কাজের ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব তাঁকে দেয়া হয়। এই চ্যালেঞ্জিং কাজে যখন কাউকে পাওয়া যায়নি, দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ জনাব মুসা হাসিমুখে এ দায়িত্ব পালনের শপথ নেন। পাক হানাদারদের চোখ এড়িয়ে বহুবার জীবন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেও তিনি এ কাজে শঙ্কিত বা ভীত হয়ে পড়েননি। হাজার হাজার যুবকের মতো স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গীকৃত এই নির্ভিক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ৮নং সেক্টরে ভারতীয় সাংবাদিক মি. জ্যোতি সিংসহ পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়েন এবং পাক সেনারা তাঁর উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাবার পর তিনি মারা গেছেন বলে যশোরের চাঁচড়া স্কুলের ঘরে ফেলে রেখে যায়। ৮নং সেক্টরের বীর যোদ্ধা ক্যাপ্টেন নাজমূল হুদা পরের দিন আমার কাছ থেকে খবর পেয়ে তাঁর ফোঁর্স নিয়ে জনাব মুসাকে অজ্ঞান ও মুমূর্ষুু অবস্থায় সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন এবং তিনি প্রাণে বেঁচে যান। মুক্তিযুদ্ধে সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে জনাব মুসার অপরিসীম অবদান এবং বীর যোদ্ধা ক্যাপ্টেন হুদা যেভাবে পাক সেনাদের গোলা বৃষ্টির মধ্যে নিজের জীবনের নিরাপত্তা উপেক্ষা করে মুসার জীবন বাঁচিয়েছেন, সে জন্য তাঁদের উভয় জনের নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করার জন্য এবং তাঁদের কাছে জাতির ঋণ স্বীকার করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সরকারের পক্ষে আমি এখানে স্বাক্ষর করলাম।” এ সেই সময়ের কথা, যখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। যখন বাংলার হাজার হাজার তরুণ-কিশোর থ্রি নট থ্রি হাতে সকালে ফ্রন্টে গেছে, সায়াহ্নে পাক সেনাদের কামানের গোলায় মাংস-পি-ের দলা হয়ে ফিরে এসেছে। কাপড়ে বাঁধা সেই তরুণ-কিশোরদের মাংস-পি-ের দলা ছুঁয়ে তার সহযোদ্ধারা ‘জয় বাংলা’ মরণ জয়ী রণধ্বনি কণ্ঠে তুলে নিয়ে সেই সায়াহ্নে বীর বিক্রমে পা বাড়িয়েছে ফ্রন্টের গোলা বারুদের মধ্যে। ফিরে আসেনি তারা কেউ প্রভাতে!

এ সেই হিরন্ময় সময়ের কথা। এ সেই পুণ্যময় ‘৭১ এর কথা।

সেই ‘৭১-এর মে মাসের প্রথম সপ্তাহের একদিন দিনাজপুরের পাক সেনাদের রামসাগর ডিফ্রে পরিদর্শনে ঢাকা থেকে গোপনে একজন ভিআইপি আসছেন এবং সেজন্যে দিনাজপুর সার্কিট হাউস রং চং করা হচ্ছে বলে দিনাজপুর শহরের এক রং ব্যবসায়ী সূত্রে ৭নং সেক্টরের শিববাড়ি ক্যাম্প ইনচার্জ কমান্ডো জর্জ গোপনে এ তথ্য পেয়ে যায়। তখন থেকে তার শুরু হয়ে যায় ভিআইপিকে এ্যাম্বুশে ফেলার প্রস্তুতি।

কিন্তু কে সেই ভিআইপি? কোন তারিখে সে ভিআইপি আসবে? কোন কোন রোড দিয়ে, কোথায়, কোথায়, যাবে সে ভিআইপি? এসবের কিছুই জানতে না পেরে, শিববাড়ি ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা খুব হতাশ হয়ে পড়ে। ক্যাম্প ইনচার্জ কমান্ডো যোদ্ধা জর্জ ভিআইপি অপারেশনের জন্য তার ক্যামপের সকলকে যে কোন মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলে রাখেন। দিনাজপুর শহরের ওই রং ব্যবসায়ীর সঙ্গে আঠার মতো একজনকে লাগিয়ে রাখেন তিনি। যদি কোন সোর্সে, কোন তথ্য পাওয়া যায়, তৎক্ষণাৎ যেন তা শিববাড়ি ক্যাম্পে পৌঁছে যায়। শেষ পর্যন্ত মে মাসের অর্ধেক চলে যায়, ভিআইপি’র নাম-নিশানা না পেয়ে শিববাড়ির মুক্তিযোদ্ধারা ভুলেই গেল ভিআইপির কথা!

অকস্মাৎ মে মাসের শেষ সপ্তাহের এক বুধবারে দিনাজপুর সার্কিট হাউসের বাবুর্চির কাছ থেকে দিনাজপুরের ওই রং ব্যবসায়ী খবর পায় যে, পরদিন ঢাকা থেকে আসবে জল্লাদ টিক্কা খান, যাবে রামসাগর পাক ডিফ্রে পরিদর্শনে। এ খবরে থর থর করে কেঁপে ওঠে শিববাড়ি ক্যামপের ইনচার্জ কমান্ডো যোদ্ধা জর্জ। এ খবরে দুলে ওঠে শিববাড়ি ক্যামপ। সাজ সাজ রব পড়ে যায় শিববাড়ি কমান্ডোদের মধ্যে।

কে নেবে জল্লাদ টিক্কার জীবন? কে দেবে জল্লাদ টিক্কার জন্য নিজের জীবন? ‘জয় বাংলা’ রণহুঙ্কারে দাঁড়িয়ে পড়ে সকলে। জল্লাদ টিক্কার ওপর আঘাত হানতে যাবার আনন্দে কেঁদে ফেলে কেউ কেউ। দু’হাত তুলে কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহর কাছে এই বলে দোয়া করে কেউ কেউ ”হে আল্লাহ আমাদের লাখ লাখ মা-বোনের ইজ্জত হরণকারী ও আমাদের লাখ লাখ ভাইবোনের হত্যাকারী জল্লাদ টিক্কা খানের ওপর প্রতিশোধ নেবার এই সুযোগ আমাদের কামিয়াব করো, সফল করো...”। শিববাড়ি ক্যাম্প ইনচার্জ জর্জ তাদের মধ্যে থেকে সাহসী ও ক্ষিপ্রগতি সমপন্ন কয়েকজন দুর্ধষ মুক্তিযোদ্ধাকে বাছাই করেন এ্যাম্বুশের জন্য।

এবি/এইচএন

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

নওগাঁয় গাছের হাট নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের ঔদ্ধত্যতা

নওগাঁয় সপ্তাহের প্রতি বুধবার বসা গাছের হাটের জায়গা...

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে নেই কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে আসা লক্ষাধিক রোহিঙ্গা...

আইপিএলে ১৩ ক্রিকেটারের নাম পাঠালো বিসিবি

পরবর্তী আরও তিনটি মৌসুমের আইপিএলের জন্য ১৩ ক্রিকেট...

নাগরিক সেবা পেতে চরম দুর্ভোগে রাজধানীরবাসী

নাগরিক সেবা পেতে চরম দুর্ভোগে রাজধানীর দুই সিটি ক...

পদ্মাসেতু হয়ে ঢাকা-বেনাপোল ট্রেন চলাচল শুরু ২ ডিসেম্বর

পদ্মাসেতু হয়ে বহুল প্রতীক্ষিত ঢাকা-যশোর-খুলনা-বেনা...

দেশের ৬১ শতাংশ মানুষ চান আগামী এক বছরের মধ্যে নির্বাচন হোক

দেশের ৬১ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ আগামী এক বছরের মধ্যে...

লেবাননে এক দিনে নিহত ৫৯

বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) দক্ষিণ লেবানন জুড়ে হামলা...

ঝিনাইদহে দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ১

ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে এ...

পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু 

গাজীপুরের শ্রীপুরে পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার...

রাজবাড়ীর জান্নাতুল দুই স্বামীকে ম্যানেজ করেই চলেছেন!

চলচ্চিত্র বা গল্প-উপন্যাসে চরম ক্লাইমেক্স কিংবা থ্...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা