গোপাল অধিকারী: মানুষ সকলে একই কিন্তু সৃষ্টিকর্তা ভিন্ন। সৃষ্টিকর্তা ভিন্ন হলেও তাদের মতবাদ এক ও অভিন্ন। কোন ধর্মেই অপরাধ আর অন্যায়কে সঠিক বলে বাহবা দেয় নি। সকল ধর্মেই মিথ্যাকে মহাপাপ বলে উল্লেখ করেছেন। শান্তিময় পৃথিবীর কথা বলেছেন। সহঅবস্থানে বসবাসের কথা বলেছেন। সুতরাং মতবাদের দিক থেকে আমরা এক ও অভিন্ন বলতে পারি। “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার কথাটির মধ্যে সহঅবস্থানের কথাই ফুটে ওঠে। তাইতো শারদ উৎসবের ছোঁয়া সকলের প্রাণে সঞ্চার হোক এই প্রার্থনা মনে হয় মন্দ হয় না।
২০ অক্টোবর থেকে ষষ্ঠীপূজার মাধ্যমে শুরু হতে যাচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসবের। আনুষ্ঠানিকতা সেদিন হলেও মূলত ১৪ অক্টোবর মহালয়ার পর থেকেই পূজার্থীদের মধ্যে দুর্গাপূজার আগমনধ্বনি শুরু হয়ে গেছে। শ্রী শ্রী চন্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার আবাহনই মহালয়া হিসেবে পরিচিত। আর এই “চন্ডী”তেই আছে দেবী দুর্গার সৃষ্টির বর্ণনা। শারদীয় দুর্গাপূজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো এই মহালয়া। পুরাণমতে, এদিন দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটে। এ দিন থেকেই দুর্গাপূজার দিন গণনা শুরু হয়। দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হবে দুর্গোৎসব। সকলেই বলি ভাল-মন্দ মিলেই জীবন। তারপরও কিন্তু থেকেই যায়। বিশেষকরে অসুররূপী অমানুষগুলোকে নিয়ে ভাল থাকাটা সকলেরই কাম্য নয়। তবুও কখনও কখনও বেড়ে যায় এই অসুরক’লের অস্তিত্ব। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে সৃষ্টি করে নানা বিনষ্ট। যেভাবে অসুরদের হুংকারে কম্পিত হয়েছিল দেবকূলের অস্তিত্ব। তবে যা কিছু মন্দ তা চিরস্থায়ী নয়। তাইতো দেবীর আগমনে দেবকূল ফিরে পেল নিজ রাজ্য। নাম হলো তার দুর্গা।
বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গা সমস্ত অশুভ শক্তি বিনাশের প্রতীক রূপে পূজিত। মহামায়া অসীম শক্তির উৎস। পুরাণ মতে, মহালয়ার দিনে, দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের দায়িত্ব পান। দুর্গা নামের বুৎপত্তিগত অর্থ যিনি দুর্গ অর্থাৎ সঙ্কট হতে ত্রাণ করেন। শাস্ত্রে ‘দুর্গা’ শব্দটির একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে ‘দুর্গা’র ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, ‘উ-কার’ ( ু ) বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ (র্ ) রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও ‘আ-কার’ ( া ) ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। পন্ডিতরা বলছেন, শরৎকালের প্রথম শুক্লপক্ষের প্রতিপদ তিথিতে মহালয়ার দিনে দেবীঘট স্থাপন করে শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। শরতকালের এ পক্ষকে দেবীপক্ষও বলা হয়ে থাকে। শাস্ত্রে আছে, দেবীদুর্গা হিমালয়বাসিনী দক্ষরাজার কন্যা।
পিতৃগৃহে আগমন উপলক্ষে ষষ্ঠীর দিনে বিজয় শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে মর্ত্যলোকে মা দুর্গার আগমনকে স্বাগত জানানো হয়। এটিই দেবীর বোধন। এরপর যথাক্রমে মহাসপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ, অষ্টমীতে কুমারী ও সন্ধিপূজা এভাবে নবমী পার হয়ে দশমীর দিনে দেবী বিসর্জন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলেও পক্ষকাল চলে বিজয়া পুনর্মিলনী উপলক্ষে বিভিন্ন লোকজ উৎসব। দেবী দুর্গার সৃষ্টি-রহস্যসমৃদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থ শ্রীশ্রীচন্ডীতে উল্লেখ আছে, ব্রহ্মা মহিষাসুরের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দিয়েছিলেন কোন পুরুষ তোমাকে বধ করতে পারবে না। ব্রহ্মার বর পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে মহিষাসুর। একে একে বিতাড়ন করেন স্বর্গের সব দেবতার। উপায়ন্তর না পেয়ে দেবতারা অবশেষে ব্রহ্মার স্মরণাপন্ন হন। কিন্তু কী করবেন তিনি। নিজের দেয়া বর ফেরাবেন কী করে? এ অবস্থায় শিব ও অন্যান্য দেবতা সঙ্গে নিয়ে ব্রহ্মা যান স্বয়ং বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণু তাদের দুর্দশার কথা শুনে দেবতাদের বলেন, দেবতাদের নিজ নিজ তেজকে জাগ্রত করতে হবে। তখন দেবতাদের সমবেত তেজের মিলনে আবির্ভূত হবে এক নারী মূর্তি। সেই নারীই বিনাশ করবে মহিষাসুরকে। বিষ্ণুর থেকে সবকিছু অবগত হয়ে দেবতারা হিমালয়ের পাদদেশে পুণ্যসলিলা গঙ্গার সামনে এসে প্রার্থনা শুরু করেন। দেবতাদের সম্মিলিত তেজরাশি থেকে দশদিক আলোকিত করে আবির্ভূত হন এক নারীমূর্তি। ইনিই দেবী দুর্গা নামে অভিহিত। তিনি আবির্ভূত হন দশভুজারূপে। দেবতাদের সব দুর্গতি বিনাশ করায় দুর্গা দুর্গতিনাশিনী, মহিষমর্দিনী এবং অসুরদলনী নামেও পরিচিত। বৈদিক সূত্রে এ দেবীর উল্লেখ আছে। পুরাকালে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল বসন্তকালে। এ সময় দেবী দুর্গা ‘বাসন্তী’ নামে পূজিত হতেন যা এখনও প্রচলন আছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, সেদিন 'কন্যারূপে' বাপের বাড়ি অর্থাৎ মর্ত্যে আসেন দেবী দুর্গা। অসুর শক্তি বিনাশকারী দেবী দুর্গার আরাধনার মধ্য দিয়ে সমাজ থেকে দূর হবে সকল পাপ। সমাজে ফিরে আসবে শান্তি। এবছর দেবী দুর্গা আসছেন ঘোটকে। এতে রবি শস্য ভাল হবে। দেবী বিদায়ও নেবেন ঘোটকে চরে।
মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার পরিবারসমন্বিতা মূর্তির প্রচলন হয় ষোড়শ শতাব্দির প্রথম পাদে। পরিবারসমন্বিতা এই মূর্তিকাঠামোর মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী ও মহিষাসুরমর্দিনী। তাঁর উপরিভাগে ধ্যানমগ্ন মহাদেব। মহিষাসুরমর্দিনীর ঠিক ডানপাশে উপরে দেবী লক্ষ্মী ও নীচে গণেশ; বামপাশে উপরে দেবী সরস্বতী ও নীচে কার্তিক। পরিবারসমন্বিতা এই রূপে দুর্গাপূজা প্রথম অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার তাহিরপুরে। কংসনারায়ণের পূজার পরপরই আড়ম্বরপূর্ণ দুর্গাপূজার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন অবিভক্ত বাংলার জমিদাররা। নতুন আঙ্গিকের এই পূজার শাস্ত্রীয় ও সামাজিক আয়োজন অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় দুর্গাপূজা পরিনত হয় জমিদারদের উৎসবে। জমিদারী প্রথা বিলোপের পর দুর্গোৎসবে জমিদারদের অংশগ্রহণের হার কমে আসে স্বাভাবিকভাবেই। নব্য ধণিকশ্রেণীর উদ্ভবের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্গোৎসব আয়োজকগোষ্ঠীতে যুক্ত হয় অনেক নতুন মুখ। তবে প্রতিটি দুর্গোৎসবই তখন আয়োজিত হত সম্পূর্ণ একক উদ্যোগে।
আনুমানিক ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দে একটি ঘটনা ঘটে অবিভক্ত বাংলার পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ায়। গুপ্তিপাড়ার একটি ধনী পরিবারের আকস্মিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে অনিশ্চয়তার সন্মূখীন হয় বাড়িটির বাৎসরিক পূজার আয়োজন। গুপ্তিপাড়ার বারো জন বন্ধুস্থানীয় যুবক তখন এগিয়ে আসে সামনে। এই বারো জন ‘ইয়ার’ বা বন্ধু সংঘবদ্ধ ভাবে গ্রহণ করে পূজাটির দায়িত্ব। গুপ্তিপাড়ার এই পূজাটি মানুষের কাছে পরিচিত হয় ‘বারোইয়ারি’ বা বারোয়ারি পূজা নামে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বাংলায় দুর্গাপূজার সংখ্যা বাড়ল ব্যাপকহারে। তারপর থেকেই বিভিন্ন বাড়োয়ারী মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় উৎসবটি। তবে বাড়োয়ারী সেই মনোভাবটা কেমন যেন থমকে যাচ্ছে। তবে কি আমরা পূর্বের জমিদারী প্রথায় ফিরে যাচ্ছি?? বর্তমান বাস্তবতার এই সমাজে সবচেয়ে বড় শারদীয় উৎসবে সকলের সাথে সাক্ষাৎ হয় বলে আমার মনে হয় না। অথচ উৎসব আসে সম্প্রীতি বাড়াতে। মাঝে মাঝে মনে হয় যে, আমাদের ধর্মে এমন কোন বিধান নেই বা আমরা মনে করি না যে, প্রতিদিন সন্তানকে সাথে নিয়ে একটি তিথিতে বা পূজা অর্চনায় সকলে মিলিত হবো? সকলের সাথে ভাব বিনিময় হবে। যার মাধ্যমে সম্প্রীতি বা আন্তরিকতাবোধ বাড়বে। প্রজন্ম শিখবে কিভাবে সমাজে চলতে হয়। অর্থ্যাৎ দৈনন্দিন একসাথে আলিঙ্গন করার কোন বিধান নেই যেটা করলে ধর্মীয় বোধ জাগ্রত হতো, পরিচিতি বাড়ত, প্রতিনিয়ত আলোচনা হতো, সামাজিকতা বৃদ্ধি পেত। এবছর উৎসবের সময়টি একটু ভিন্ন মনে হয়। দেশে নির্বাচন সামনে থাকায় শারদীয় উৎসবটি নিয়ে হয়ত শঙ্কিত অনেকে। কিন্তু যেহেতু এটি সবচেয়ে বড় একটি উৎসব তাই সার্বজনীন এই উৎসব সম্পন্ন করার দায়িত্ব সকল রাজনৈতিক দলের।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ঠ হলে কোন দল এ দায় এড়াতে পারে না বলে আমি মনে করি। এককথায় রাজনৈতিক কোন নাটকের ইস্যু আমরা হতে চাই না। এবছর সারা দেশে ৩২ হাজার ৪০৭টি মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত সকল কিছইু অন্যের উপর নির্ভরশীল। এক অপরকে সহযোগীতা নিয়ে বা সহযোগী হয়েই চলতে হয়। সুতরাং শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপনে যুদ্ধ বা সংঘাত, হিংসা বা দ্বন্দ্ব কখনোই কারো কাম্য হতে পারে না। তবুও বিভিন্ন কারণেই ঘটে যুদ্ধ। কখনও তা দেশের অভ্যন্তরে কখনও আবার দেশের সাথে দেশের যা পরিণত হয়েছে বিশ্বযুদ্ধে। বিশ্বমন্ডলও একটি পরিবারের মত। পরিবারে যেমন একজন সদস্যের সাথে দ্বন্দ্ব বাধলে বাকিদের প্রভাব পড়ে ঠিক যুদ্ধও তেমন। আমরা বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস জেনেছি তাতে দেখা যায় কোন যুদ্ধই শান্তির বার্তা আনেনি। যুদ্ধের ফল যে কখনো সুখের হয় না, অতীতে ফিরে তাকালেই তা দেখা যায়। ইতিহাসের পাতা থেকে রইল তেমনই কিছু ভয়াবহ যুদ্ধ, যেগুলিতে প্রাণ গিয়েছিল অসংখ্য মানুষের। যুদ্ধ করে কেউ কখনো শান্তির পুরষ্কার অর্জন করেনি। যুদ্ধ করে কারো নাম ইতিহাসে ঠাঁই করে নেই নি। সুতরাং যুদ্ধ শুধু আনে ধ্বংস আর মৃত্যু। আনে হাহাকার আর দারিদ্র্য।
যুদ্ধে যে দেশ নিজেকে বিজয়ী বলে ঘোষণা দেয়, প্রকৃতপক্ষে সে বিজয় দেশটির কোনো স্থায়ী সাফল্য এনে দেয় না। আপাতত বীরত্বের খেতাবে ভূষিত হলেও বৃহত্তর অর্থে সেটা তার ক্ষতির কারণই হয়। শান্তির জন্যই পৃথিবীতে অমর হয়ে আছেন অনেক মনীষী। আমার পাশের বাড়ির মানুষটি যদি ভাল না থাকে তাহলে মানবিক মানুষ হিসেবে মনে হয় আমার ভাল থাকার কথা না। সেই মানবিকতায় দূর্গোৎসব যদি সার্বজনীন সম্প্রীতি বৃদ্ধি না করে তাহলে মনে হয় শান্তিময় পৃথিবীর স্বপ্ন কল্পনীয়। কারণ মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আমরা ভাল থাকলে ভাল থাকবে পৃথিবী। শারদীয় দূর্গোৎসব হোক সম্প্রীতির উৎসব সেই কামনায় সকলের প্রতি শারদীয় প্রীতি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট