প্রখ্যাত অভিধান প্রণেতা শ্রী জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস এবং বঙ্গীয় শব্দকোষ প্রণেতা শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো অজ্ঞাত কারণে তাদের অভিধান সংকলনে ‘মানবতা’ ভূক্তিটি যুক্ত করেননি। এই ঘটনার ১০০ বছর অতিক্রান্ত আজ।
অভিযোগের জবাব দেওয়ার জন্য অভিধান সংকলকগণ আজ আর বেঁচে নেই। তাই কিছু কথা এই নালায়েক অধমকেই লিখতে হচ্ছে।
চণ্ডীদাস (কোন চণ্ডীদাস মনে নেই) বিরচিত একটি চরণ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’— খণ্ডিতভাবে এটিকে মানবতাবাদী চরণ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। তবে মূল পদটি দেখলে তেমন মনে হওয়ার কারণ নেই। আসুন, এর আগের চরণগুলো দেখে আসি—
কেবা অনুগত কাহার সহিত/জানিব কেমনে শুনে/মনে অনুগত মুঞ্জরী সহিত/ভাবিয়া দেখহ মনে/দুই চারি করি আটটা আখর/তিনের জনম তার/এগার আখরে মূল বস্তু জানিলে/একটি আখর হয়/চণ্ডীদাস কহে, শুন হে মানুষ ভাই/সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপর নাই।
এটি যে কোনো মানবতাবাদী পদ নয় এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন। রাধার মান-অভিমান বিষয়ক রচনা। রামী, বড়ু, দ্বিজ বা সহজিয়া কোনো চণ্ডীদাসের রচনায়ই ‘মানবতা’র কথা নেই। এই পদে মানুষ অর্থ গুরু। যেমন, অন্য এক পদে পাই ‘চণ্ডীদাসে কহে তুমি সে গুরু/তুমি সে আমার কল্পতরু।’
উপরের পদে ‘মুঞ্জরী’ কথাটা দ্রষ্টব্য। রাধা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রাণপ্রিয়া। ব্রজ মণ্ডলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তার কৃপা বিনা কেউ ব্রজে প্রবেশ করতে পারে না। সব গোপীরা তার কায়রূপা স্বরূপা। তার কান্তি থেকে সব গোপীরা প্রকট হয়েছে। তার সখীদের অনেক যুথ আছে। গোপীদের ‘কিংকরী’, ‘মুঞ্জরী,’ ‘সহচরী’ আলাদা আলাদা যুথ আছে। ললিতা, বিশাখা, চিত্রা, চম্পকলতা, সুদেবী, তুঙ্গবিদ্যা, ইন্দুলেখা এবং রঙ্গদেবী— এই আটজন রাধার প্রধান সখী। এর মধ্যে সবচে প্রিয় ললিতা, যাকে অনুরাধা বলা হয়ে থাকে। ‘মুঞ্জরী’ যুথ মূলত নিজেরা কৃষ্ণের সাথে লীলায় অংশ নেয় না, তারা রাধাকে কৃষ্ণের সাথে একান্তে সময় কাটাতে সাহায্য করে। ‘মানবতার পাঠ’ নিয়ে আমরা নিশ্চয় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য পড়ি না। মানবতা বা হিউম্যানিজম এই অঞ্চলে যদি কারো রচনায় তীব্রভাবে ধরা পড়ে থাকে তিনি হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এর আগে যিনি এই পথে হেঁটেছিলেন তিনি মহর্ষি মনোমোহন দত্ত। তার সর্বধর্মগীতিকা সমূহ প্রভু এবং জীবের সম্পর্কবাহী আলোকবর্তৃকা। হিন্দু-মুসলিম সহাবস্থানের জয়গান তিনি গেয়েছেন তীব্র সাম্প্রদায়িক সময়ে। মহর্ষির ক্ষণকালের জীবনের এই অধ্যায়টি সম্পর্কে সকলেই কমবেশী অবগত। তার অমর বাণীকে সুরে সুরে প্রচার করেছেন সঙ্গীত গুণাকর ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁ সাহেব, যিনি নিজেও একজন প্রবল আধ্যাত্মিক মানুষ হিসেবে সর্বজনবিদিত।
মহর্ষি মনোমোহন দত্ত বঙ্গাঞ্চলের দুটো প্রধান কেন্দ্র ঢাকা বা কলিকাতায় বসে তার মৌলিক জ্ঞানের চর্চা করেননি বলে সেটি বিকশিত হতে সময় লেগেছে।
এইচএমভি কিংবা গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইন্ডিয়াও তার বিরচিত গানের কোন রেকর্ড প্রকাশ করেনি। পাকিস্তান আমলে সর্বপ্রথম রেডিওতে তার গান মলয়া সঙ্গীত আকারে প্রচার পেতে থাকে। আর এই প্রচারে প্রমুখ ভূমিকা পালন করেন মরমী শিল্পী হাসান আলী খান সাহেব। আজ মহর্ষি ও মলয়া এক ও অভিন্ন।
এখন মূল আলোচনায় আসি। সাতমোড়াতে যে সুর বেজেছিলো, সেই সুরের কাণ্ডারী মহর্ষি মনোমোহন দত্ত খুব অল্প সময় দৃশ্যমান পৃথিবীতে বিচরণশীল ছিলেন। তার পুত্র শ্রী সুধীরচন্দ্র দত্ত মহাশয়ের হাত ধরে পৃথিবীতে আসেন ‘জীবন্ত মনোমোহন’ খ্যাত শ্রী বিল্বভূষণ দত্ত। আজ ৯ এপ্রিল মহর্ষি মনোমোহন দত্তের পৌত্র বিল্বভূষণ দত্তের দ্বিতীয় প্রয়াণ বার্ষিকী।
তার নামকরণের মধ্যে ‘বিল্ব’ শব্দটির দিকে অনেকেই ইঙ্গীত প্রকাশ করেছেন। যারা সাতমোড়া আনন্দ আশ্রম পরিভ্রমণ করেছেন তাদের চোখে পড়েছে লাল কাপড় দিয়ে বাঁধা একটি বৃক্ষ। এটি মহর্ষির সাধনার স্থল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন ধ্যান করতেন শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলায়, তেমনি পূর্ববঙ্গের এই অবিসংবাদিত মহর্ষি ধ্যানমগ্ন হতেন বেলগাছের তলায়। এই বৃক্ষের নামেই নামকরণ করা হয় মহর্ষির পৌত্র বিল্বভূষণ দত্তের। আর ঐতিহাসিকভাবে আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি যে এই দুই মহর্ষি খুব কাছাকাছি সময়ে ইহধাম ত্যাগ করেছেন। (যদিও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এক দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন।)
বৃহত্তর মেঘনা-তিতাস-গোমতী তীরের মানুষ আজো বিশ্বাস করেন যে বিল্বভূষণ দত্ত ছিলেন ‘জীবন্ত মনোমোহন’। আশ্চর্য হই আমরা যখন দেখি এই অনন্য মানুষটি সমগ্র জীবন মহর্ষির জীবন-দর্শন-সাধনা প্রচার করে গেছেন। (তার আকস্মিক প্রয়াণের পর এই কাজটি করে যাচ্ছে সাধ্বী শংকরী দত্ত এবং তার পুত্রকন্যাগণ।)
উপমহাদেশের একটি জনপ্রিয় শব্দ ‘পরম্পরা’। অপরটি ‘ঘরাণা’। উপমা হিসেবে কিরাণ ঘরাণার কথা ধরি। খানসাহেব আবদুল করিম খাঁর পর কিরাণ ঘরাণার শ্রেষ্ঠতম মুখ পণ্ডিত সোয়াই গান্ধর্ভ। এরপর তার ছাত্র ভারতরত্ন পণ্ডিত ভীমসেন যোশী। এরপর এই ঘরাণার সেরা মুখ বিদুষী প্রভা আত্রে। একই পরিক্রমায় মৌলিক জ্ঞানের বাণীবাহক হিসেবে মহর্ষির পরিবারের বর্তমান উত্তরাধিকারীগণও সঠিক পথেই এগুচ্ছেন।
আজকের এই শোকাবহ দিনে মহর্ষিপৌত্র স্বর্গীয় বিল্বভূষণ দত্ত মহাশয়ের বিদেহী আত্মার পারলৌকিক শান্তি কামনা করছি।
লেখক: সাহিত্যিক ও শিল্প সমালোচক।
আমারবাঙলা/এমআরইউ