রফিক সুলায়মান, ছবি : সংগৃহীত
মতামত

নজরুল সঙ্গীত চর্চা ও বিকাশে বাংলাদেশের নারী শিল্পীদের অবদান

রফিক সুলায়মান

মহৎ মানুষের সৃষ্টিতে এক বিস্ময় কাজ করে। সত্যজিৎ রায়ের এত এত সৃষ্টি থাকতেও, ঘুরেফিরে চোখ আটকে যায় অপু-দুর্গাতেই। এস এম সুলতানের শত শত শিল্পকলার ভিড়ে ‘প্রথম বৃক্ষরোপণ’ এক আলাদা মাত্রায় দেদীপ্যমান। নজরুলের সংগীত জীবনের ঊন্মেষলগ্নে যেসব শিল্পী তার গান রেকর্ড করেছিলেন, যেমন আঙ্গুরবালা-ইন্দুবালা-জ্ঞান গোস্বামী প্রমুখের গায়কিকে আজও কেউ অতিক্রম করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর ঢাকাকেন্দ্রিক সংস্কৃতিচর্চার দিক উন্মোচিত হলো। ঝাঁকে ঝাঁকে মুসলমান কলাপ্রেমী এখানে আসতে শুরু করলেন। ঢাকা মুখরিত হলো জয়নুল আবেদিন-আব্বাসউদ্দীনের পদচারণে। স্বভাবতই নজরুল সংগীতের একটা লাগসই প্রেক্ষাপট গড়ে উঠল এখানে।

পুরুষ শিল্পীদের পাশাপাশি নারী শিল্পীরাও ঢাকায় শুরু করলেন নজরুল সংগীতের চর্চা। অভিজাত মুসলিম পরিবারে নজরুলের কদর তো ছিলই; কেউ শুনে শুনে, কেউ বা ওস্তাদ শিক্ষক রেখে গান শেখা শুরু করলেন। লায়লা আরজুমান্দ বানু, মাহবুবা রহমান, আফসারি খানম, শওকত আরা ইসলাম প্রমুখ প্রথম দিককার নারী শিল্পী, যারা বিশুদ্ধ নজরুলগীতি পরিবেশনার মাধ্যমে সারা দেশে পরিচিতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর আগে নজরুলের সুস্থাবস্থায় বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় গিয়ে নজরুলের তিনটি গান রেকর্ড করেছিলেন মীনা বন্দ্যোপাধ্যায়। (সম্প্রতি প্রয়াত মোবারক হোসেন খান একটি লেখায় অবশ্য দুটি গানের কথা উল্লেখ করেছেন। ‘এসো নওলকিশোর’-এর কথা উল্লেখ করেননি।) এর পরপরই তিনি বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলা সংগীতজগতের জন্য এ ছিল এক অপূরণীয় ক্ষতি। ব্রহ্মমোহন ঠাকুর ‘নজরুলসংগীত নির্দেশিকা’য় তিনটি নজরুল সংগীত রেকর্ডের তথ্য পরিবেশন করেছেন। তিনটি গানই ১৯৪১ সালে রেকর্ডভুক্ত হয়।

বাংলাদেশকেন্দ্রিক নজরুলসংগীতের চর্চায় নারী শিল্পীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তবে সবার গায়কি বা পরিবেশনা সমান তাৎপর্যপূর্ণ নয়। অনেক শিল্পীই বাণীর গভীরতা উপলব্ধি না করেই গেয়েছেন অতীতের কোনো রেকর্ড অনুসরণ করে। ১৯৪৭ থেকে এ পর্যন্ত রেকর্ড করা নারী শিল্পীদের গান তুলনামূলকভাবে বিচার করলে আফসারি খানম, নীলুফার ইয়াসমিন, ফাতেমা-তুজ-জোহরা, জান্নাত আরা ও ইয়াসমিন মুশতারি শামার গাওয়া নজরুল সংগীতকে একদিকে রাখতে হয়। আফসারি খানমের ‘আমি সন্ধ্যা-মালতী’ একটি চমৎকার গান, যার রেশ গান শেষ হওয়ার পরও থেকে যায়। নীলুফার ইয়াসমিনের এ রকম অনেক উদাহরণ আছে। ইয়াসমিন মুশতারি শামা’র গাওয়া ‘পরান প্রিয়! কেন এলে অবেলায়’ সম্ভবত বাংলাদেশের কোনো শিল্পীর রেকর্ড করা সেরা গান। পিলু/দাদরা অঙ্গের এই গান এর আগে সুকুমার মিত্র, মানিকমালা (১৯২৯/১৯৩৫), মৌসুমী রায় (কানাডাপ্রবাসী) প্রমুখ শিল্পী রেকর্ড করেছিলেন। সম্প্রতি সালাউদ্দিন আহমেদও গানটি রেকর্ড করেছেন। কিন্তু কবি তালিম হোসেনের কন্যা, বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নজরুল সংগীতশিল্পী ইয়াসমিন মুশতারি শামার কণ্ঠে এ গান বিশেষ উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে। আধুনিক গানের যন্ত্রানুষঙ্গী হিসেবে দূর্বাদল চট্টোপাধ্যায় ব্যাপক পরিচিত হলেও এ গানে তিনি বিশিষ্টতার ছাপ রেখেছেন। অকালপ্রয়াত শিল্পী জান্নাত আরার গাওয়া ‘আমার প্রিয় হজরত’, ‘মনে রাখার দিন গিয়েছে’ এবং ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’ গান তিনটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। তিনি ছিলেন নজরুল সঙ্গীতের এক বিস্ময়কর কণ্ঠ।

শওকত আরা ইসলাম (আবার কি এলো রে), আখতার জাহান (বলো প্রিয়তম বলো এবং একেলা গোরী জলকে চলে গঙ্গাতীর), ইসমত আরা, রওশন আরা মাসুদ (মেঘমেদূর বরষায়), ফরিদা ইয়াসমিন (আমি দ্বার খুলে আর রাখবো না), নীলুফার ইয়াসমিন, দিলশাদ আমিন, ফওজিয়া খান, মিলিয়া আলী, হুসনা বানু খানম, রওশন আরা মাসুদ, নীলিমা দাশ, অঞ্জলী রায় প্রমুখ শিল্পী পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে ঢাকা কেন্দ্রীয় নজরুলসংগীত চর্চায় যথেষ্ট নাম কামিয়েছিলেন। আজও পুরাতনি আড্ডায় তাদের কথা আলোচিত হয়। এ ছাড়া রেবেকা সুলতানা (খেলিছে জলদেবী), সাবিহা মাহবুব, রওশন আরা সোমা (তোমার বুকের ফুলদানিতে), সিফাত-ই-মনজুর (জনম জনম গেলো আশা পথ চাহি), শাহিন সামাদ, ফাতেমা-তুজ-জোহরা (তোমার নামে একি নেশা/ আমার নয়নে নয়ন রাখি/কূল রাখো না রাখো), সাদিয়া আফরিন মল্লিক (রেশমি রুমালে, তুমি যদি রাধা হয়ে শ্যাম, নামাজ রোজা হজ্ব জাকাতের পশারিণী আমি), ড. নাশিদ কামাল (এই মুছিনো আঁখি যাও যাও তুমি ফিরে, চাপা রঙের শাড়ী), বিপাশা গুহঠাকুরতা (‘আমি না হয় মান করেছিনু’, ‘খেলা শেষ হলো’, ‘কে নিবি মালিকা’, ‘বরণ করেছি তারে সই’), ডালিয়া নওশিন (হংস মিথুন ওগো), বদরুন্নেসা ডালিয়া (চিকন কালো বেদের কুমার), রাহাত আরা গীতি (চোখ গেল, একাদশীর চাঁদ), ফেরদৌস আরা (জনম জনম গেলো আশা পথ চাহি), রওনক আরা রাসেল, শবনম মুশতারি (লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া’, ‘পিয়া পিয়া পিয়া পাপিয়া পুকারে’), রুনা লায়লা (গুলবাগিচার বুলবুলি আমি), শিমুল ইউসুফ, আসমা খান, পারভীন সুলতানা (এ কোন মধুর শরাব দিলে), রেহানা রহমান, শারমিন সাথী ময়না, নাসিমা শাহীন, ছন্দা চক্রবর্তী, ফেরদৌসী রহমান চন্দন, নাহীদ মোমেন, মিরাজুল জান্নাত সোনিয়া প্রমুখ শিল্পী নজরুল সংগীত পরিবেশনায় যথেষ্ট মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন।

বাংলাদেশকেন্দ্রিক নজরুল সংগীত চর্চায় ফিরোজা বেগম ও ফেরদৌসী রহমান কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। এ দেশের সকল নারী শিল্পীর আদর্শ এই দুজন। ফিরোজা বেগম নজরুলের স্নেহধন্য কমল দাশগুপ্তের সহধর্মিণী। তিনি যখন গান রেকর্ড শুরু করেন, তখন কবি মূক ও অসুস্থ। তবে তেমন অবস্থায়ও তার গান শুনলে কবি উৎফুল্ল হতেন, উদাস হতেন। কমল দাশগুপ্তের পরিচালনায় তিনি অনেক নজরুল-সংগীত রেকর্ড করেছেন। বাংলাদেশের একমাত্র শিল্পী তিনি, যার গানের অ্যালবাম ঢাকা, কলকাতা ও লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

অন্যদিকে, ফেরদৌসী রহমান ভাওয়াইয়া ও নজরুলসংগীতের প্রাণভোমরা আব্বাসউদ্দীনের কন্যা। ১৯৫৯ সালে আব্বাসউদ্দীন যখন প্রয়াত হন, তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আমাদের সংগীতে জগতের নারী শিল্পীদের রোল মডেল তিনি। সংগীত সাধনা ও পবিত্র জীবন-যাপনের এক দৃষ্টান্ত তিনি। সংগীতকে তিনি স্রষ্টার সাধনা হিসেবে নিয়েছেন। বিশুদ্ধ রাগ-খেয়াল-লোকগান, নজরুল-সংগীত, আধুনিক, সিনেমার গান-সবখানেই তিনি নিজের স্বকীয়তা প্রমাণ করেছেন। তার ধ্রুপদ অঙ্গের কলাবতী রাগের খেয়াল যেমন আমাদের স্বপ্নাবিষ্ট করে, তেমনি নজরুলসংগীতেও তিনি বিখ্যাত বাবার সুনাম রক্ষা করেছেন।

নজরুল যখন সঙ্গীত সাধনায় ব্রতী হন তখন যেসব নারী শিল্পী তার গান কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলেন তারা হলেন আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, যুঁথিকা রায়, পারুল সেন, দীপালী তালুকদার নাগ, কমলা ঝরিয়া, আশ্চর্যময়ী দাসী, কানন দেবী, মিস প্রমোদা, পদ্মরাণী চট্টোপাধ্যায়, অনিমা বাদল প্রমুখ। একজন মুসলমান শিল্পীকে সেই দৃশ্যপটে আমরা দেখি। তিনি কুমারী আশরাফি বেবি। সাথে দুজন অবাঙালি শিল্পীও সে-সময় নজরুলের গান রেকর্ড করেছেন। একজন মড কস্টেলো, তিনি শ্বেতাঙ্গিনী। অন্যজন শান্তা আপ্তে, হিন্দি সিনেমার নায়িকা এবং গায়িকা। পরে অবাঙালি শিল্পীদের মধ্যে আশা ভোশলে এবং অনুরাধা পাড়োয়াল নজরুলের গানের এলবাম প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের প্রায় সব নারী শিল্পী নজরুলের গান গাইলেও আনজুমান আরা বেগম নজরুলের গান গেয়েছেন বলে আমরা শুনিনি। কলিকাতার প্রায় সব নারী শিল্পী নজরুল সঙ্গীত রেকর্ড করেছেন। ভারতের সুবিখ্যাত শিল্পী লতা মঙ্গেশকার নজরুলের গান রেকর্ড না করলেও কবির ‘মেঘলা নিশি ভোরে’ অবলম্বনে সুরারোপিত একটি হিন্দি গান ‘রোজ একেলি আয়ে’ গেয়েছেন। শাহনাজ রহমতুল্লাহ, নাহীদ নিয়াজি প্রমুখ বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পীর গাওয়া নজরুলের গান আমাদের হাতে এসেছে।

বাংলাদেশে নজরুলসংগীত চর্চা ও বিকাশে নারী শিল্পীদের অবদান সোনার হরফে লিখিত হওয়ার মতো। দেশভাগের পর ষাট দশক থেকেই কবিকে নিয়ে যে কোলাহল ও আগ্রহ শুরু হয়েছিল, তা আজও স্তিমিত হয়নি এক মুহূর্তের জন্য। কালের প্রবাহে আজ নজরুল বহুমাত্রিকতায় উদ্ভাসিত। মনের যেকোনো অনুভূতির সুপ্রকাশের জন্য আমরা গেয়ে উঠি তার গান: ‘ও বন্ধু, দেখলে তোমায়, বুকের ভেতর জোয়ার-ভাটা খেলে...।’

লেখক: শিল্প সমালোচক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

আমারবাঙলা/এমআরইউ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

লক্ষ্মীপুরে বিয়ের দাবিতে যুবকের বাড়িতে তরুণীর অবস্থান

লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে বিয়ের দাবিতে এক কলেজ শিক্ষার্...

কটিয়াদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক প্রেষনে,স্বাস্থ্য সেবা ব্যাহত

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের...

বাংলাদেশে বিনিয়োগে বড় বাধা পাঁচটি: আইএফসির প্রতিবেদন

বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগে পিছিয়ে আছে। জিডিপির অনুপা...

ভালুকের শরীরে পচন, সেই চিড়িয়াখানা সিলগালা

ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সি...

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্তে যুবককে হত্যার অভিযোগ বিএসএফের বিরুদ্ধে

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর সীমান্তে ভারতের সীমান...

শেখ হাসিনা-পুতুলসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

রাজধানীর পূর্বাচলে রাজউকের প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির...

ইঁদুরের মস্তিষ্কের মানচিত্রে ‘গ্যালাক্সির দৃশ্য’

বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের মস্তিষ্কের বড় একটি মানচিত্র তৈ...

সালমান-ঐশ্বরিয়ার প্রেম ভেঙেছিল কেন?

বলিউড ভাইজান সালমান খান এবং সাবেক বিশ্বসুন্দরী অভি...

বাঁশি তৈরিতে ১৫০ বছরের ইতিহাস আছে শ্রীমুদ্দি গ্রামের

দেশের নানা অঞ্চল সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ। এমনই একটি...

বিয়ে না করার কারণ জানালেন বলিউড অভিনেত্রী সুস্মিতা সেন

সাবেক বিশ্বসুন্দরী ও বলিউড অভিনেত্রী সুস্মিতা সেনে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা