মৌলভীবাজারের চা বাগানের বাসিন্দা দুই বোন ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা নিজেদের মধ্যে কথা বলেন মাতৃভাষা ‘খাড়িয়া’তে।
অতি বিপন্ন এ ভাষাটি তারাসহ আর মাত্র জনা পনের মানুষের মুখেই টিকে আছে। তারাও দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকায় ভাষাটির চর্চা বা ব্যবহার তেমন হয় না।
এ অবস্থায় দ্রুত সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া না হলে এ মানুষগুলোর সঙ্গে হারিয়ে যাবে ভাষাটিও।
খাড়িয়ারা বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। তাদের আদি বসতি প্রতিবেশী দেশ ভারতের ঝাড়খন্ডের রাঁচী, নাগপুর, ও অযোধ্যার পাহাড়ি এলাকায়।
মূলত সিলেট অঞ্চলে চা বাগান সৃষ্টির শুরুর সময় খাড়িয়াদের চা-শ্রমিক হিসেবে নিয়ে আসে ব্রিটিশরা। তাদের বংশধরেরাই বর্তমানে সিলেট হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে বসবাস করছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খাড়িয়ার বসবাস মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে।
খাড়িয়া নৃ-গোষ্ঠীর নেতা জহর লাল ইন্দোয়ার বলেন, খাড়িয়া সমাজ চার ভাগে বিভক্ত। সেগুলি হচ্ছে মুন্ডা-খাড়িয়া, ঢেলকী-খাড়িয়া, দুধ-খাড়িয়া ও এড়েঙ্গা-খাড়িয়া। এই চারটি সমাজ আবার বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত। যার মধ্যে শ্রীমঙ্গল ও তৎসংলগ্ন চা বাগানে যেসব গোত্র এখনো টিকে আছে সেগুলো হলো- ইন্দোয়ার, ডালমাড়িয়া, ধানোয়ার, ডুংডুং, কেরকেটা, বাঘোয়ার, বিলুঙ্গা, কেশোয়ার, খাটখাড়িয়া, হেঁঠেটু, টপোরিয়া, ধুরবুঙ্গিয়া, সুরুজপুড়িয়া ইত্যাদি।
খাড়িয়ারা মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বী। তাদের দেব-দেবীর মধ্যে প্রধান হচ্ছেন দুর্গা। তবে অনেকেই শীতলাদেবীর পূজা করেন। পাশাপাশি তারা বনদেবতারও পূজা করেন।
তিনি বলেন, সময়ের আবর্তে খাড়িয়াদের অনেকেই খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন। সনাতনী নিয়ম অনুযায়ী তাদের নিজ গোত্রে বিবাহবন্ধন নিষিদ্ধ। খাড়িয়ারা মৃতদেহ সমাহিত করে।
শ্রীমঙ্গলে খাড়িয়া অধিবাসী ঠিক কতজন আছেন তার সঠিক হিসাব না থাকলেও জহর লাল ইন্দোয়ারের ধারণা, এ সংখ্যা হাজার দুয়েক হবে। তবে পুরো সিলেট বিভাগজুড়ে হয়তো চার-পাঁচ হাজার খাড়িয়া থাকতে পারে।
তিনি বলেন, দেশে খাড়িয়াদের সংখ্যা চার-পাঁচ হাজার হলেও তাদের মাতৃভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা খুবই কম। তার মতে, খাড়িয়া মাতৃভাষায় কথা বলতে পারেন বেশি হলে ১৫-২০ জন।
এর মধ্যে শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট ইউনিয়নের বর্মাছড়া চা বাগানে কেরকেটা গোত্রের দুই বোন ভেরোনিকা কেরকেটা (৬২) ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা (৫৫) অনর্গল এ ভাষায় কথা বলতে পারেন।
একসঙ্গে বসবাস করায় তারা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলেন পুরোটাই খাড়িয়া ভাষায় বলেন।
ভেরোনিকা কেরকেটা বলেন, যারা খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন তারা আলাদা আলাদা স্থানে বসবাস করায় নিজেদের ভাষায় কথা বলার সুযোগ খুবই কম।
তিনি জানান, মায়ের কাছ থেকেই তারা এ ভাষা শিখেছেন। কিন্তু তাদের ছেলে-মেয়েরা এ ভাষা ভালো পারে না। কথা বললে তারা বুঝে, কিছু কিছু বলতেও পারে কিন্তু ভালো পারে না।
এ নারী বলেন, কাজ-কর্মে ছেলে-মেয়েরা বাইরে চলে গেলে তখন এই ভাষায় আর কথা বলার প্রয়োজন হয় না। অন্য ভাষায় কথা বলতে বলতে মায়ের ভাষাটা সন্তানরা ভুলে যাচ্ছে। তা ছাড়া খাড়িয়ারা নিজ সম্প্রদায়ের বাইরে বিয়ে করায় বাবা ও মায়ের ভাষাও ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ফলে সন্তানরা কোনো ভাষাই ভালো করে শিখতে পারে না। তারা একটি মিশ্র ভাষায় অভ্যস্ত হয়।
এসব কারণে খাড়িয়াদের মাতৃভাষাটি বিপন্ন হতে চলেছে জানিয়ে তিনি বলেন, যদি সংরক্ষণ করা না হয়, তাহলে এই মানুষগুলো যতদিন আছেন এই ভাষার আয়ুও ততদিন।
নিজেদের মাতৃভাষাটি টিকিয়ে রাখার জন্য তারা চেষ্টা করছেন জানিয়ে খ্রিস্টিনা কেরকেটা বলেন, এখন চা বাগানের কাজ শেষে সপ্তাহে দুই-তিন দিন বিকালে বাগানের খাড়িয়া গোত্রের শিশু-কিশোরদের নিয়ে তারা বসেন। সেখানে গল্পের ছলে তারা এই ভাষা শেখান।
তিনি বলেন, সংসার চালানোর জন্য তাদের কাজ করতে হয়। ভাষা শিখানোর জন্য সময় দিতে হলে অন্যকাজ তারা করতে পারেন না। তবু তারা দুই বোন কিছু সময় ব্যয় করে শিশুদের এ ভাষা শেখানোর চেষ্টা করেন।
তবে সরকারিভাবে এ ভাষা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে আরো ভালো হবে। তিনি জানান, বিপন্নের পথে থাকা এই ভাষা শুনতে অনেক বিশিষ্টজন ছুটে যান তাদের কাছে। তাদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের ছবি তুলেন। কীভাবে এই ভাষাটিকে রক্ষা করা যায় তার চেষ্টা করছে শ্রীমঙ্গল উপজেলা ও জেলা প্রশাসনও।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইসলাম উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের অতি বিপন্ন এই নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষা রক্ষায় ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছেন তারা। ভারতের রাচী জেলায় এই ভাষার হরফ রয়েছে বলে তারা সন্ধান পেয়েছেন । সেখান থেকে তা সংগ্রহের চেষ্টা করবেন।
এ ছাড়া ভাষাটি সংরক্ষণের বিষয়টি বাংলা একাডেমি ও মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে অবহিত করবেন বলে জানান এই কর্মকর্তা।
আমারবাঙলা/এমআরইউ