কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার নাফ নদীর কূল ঘেঁষে টেকনাফ মডেল থানা। থানা চত্বরে টিনের ছাউনি দেওয়া একটি গোল ঘর আছে। ঘরটিতেই পাকা করা একটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘মাথিনের কূপ’।
সাধারণ কোনো পাতকুয়া নয় এটি; এই কূপ ঘিরেই রয়েছে নিদারুণ প্রেমের গল্প। ভারতের কলকাতার পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্য আর রাখাইন কন্যা মাথিনের প্রেমের কাহিনী জড়িয়ে আছে এই কূপে। ওই প্রেমে মাথিনের করুণ মৃত্যু হয়।
মাথিনের মৃত্যুর পর কূপটি তার প্রেমের নিদর্শন হিসেবে থেকে যায়। স্থানীয় লোকজনের মুখে মুখে কূপটির নামকরণ হয়ে যায় মাথিনের কূপ হিসেবে। পরে পুলিশ প্রশাসন এটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে সেখানে একটি ফলক জুড়ে দেয়। ২০০৬ সালে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খালেদ হোসেন ও সাংবাদিক আব্দুল কুদ্দুসের উদ্যোগেই সংরক্ষিত হয় এই নিদর্শন। এর পর থেকে দর্শনার্থীরা সেখানে নিয়মিতই আসতে শুরু করেন।
কলকাতার পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্যের বিখ্যাত আত্মজৈবনিক বই ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হলে মাথিনের প্রেমকাহিনী সবার নজরে আসে। শহুরে চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা ও দুর্গম জনপদের এক আদিবাসী তরুণীর অসম প্রেমগাথা আজও পাঠককে উদ্বেলিত করে।
কলকাতার সুদর্শন পুলিশ কর্মকর্তা পরে লেখক ও অভিনেতা বনে যাওয়া ধীরাজ ভট্টাচার্যের স্মৃতিকথায় আমরা মাথিনের কথা জানতে পারি। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ধীরাজ পাহাড় ও সাগরঘেরা দুর্গম এলাকা টেকনাফ থানায় বদলি হয়ে আসেন। সমুদ্রের নীল জলরাশি আর সবুজ পাহাড়ের সৌন্দর্য ধীরাজকে মুগ্ধ করেছিল। থানায় তার তেমন কোনো কাজকর্ম ছিল না। অনেকটা এখানে–সেখানে ঘুরেফিরে সময় কাটত দারোগা ধীরাজের। থাকতেন থানার আধা পাকা ঘরের একটি কক্ষে। থানা প্রাঙ্গণে যে সুমিষ্ট জলের কূপ আছে, সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করতেন এলাকার বেশির ভাগ লোকজন। আসতেন রাখাইন তরুণীরাও।
সেখানেই দেখা অপরূপ সুন্দরী মাথিনের সঙ্গে। টেকনাফের জমিদার ওয়ান থিনের একমাত্র মেয়ে তিনি। খুব ভোরে কূপ থেকে পানি নিতে আসতেন মাথিন। নিজের অজান্তেই ওই সময় মাথিনকে দেখার অপেক্ষায় থাকতেন ধীরাজ। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় সে দৃশ্য যেন স্বর্গের অনুভূতি এনে দিত। মাথিনও এমন নীরব প্রেমের বিষয়টি বুঝতে পারলেন এবং সাড়া দিলেন। দুজনের প্রেমের সূচনা এভাবেই। ধীরাজের এই প্রেম মেনে নিতে কোনো আপত্তি ছিল না মাথিনের পরিবার ও স্থানীয় লোকজনের। তাই পরিণয়ের সম্ভাবনাও উঁকি দিতে থাকল। এমন পরিস্থিতিতে ধীরাজ বাবার চিঠি পেয়ে মাথিনকে না জানিয়ে ফিরে যান কলকাতায়। অসহায়, বঞ্চিত ও প্রতারিত মাথিন মানতে পারলেন না তা। সব ছেড়ে দিয়ে শয্যাশায়ী হলেন তিনি। একসময় ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে।
টেকনাফ থানা প্রাঙ্গণে বাঁধানো গোল একটি চত্বরে মাথিনের কূপের অবস্থান। ওপরে ছাউনি দিয়ে ঢাকা নিরিবিলি কূপটি সমাধিসৌধের চেহারা পেয়েছে। সেখানে এক পাশে ধীরাজ ভট্টাচার্যের আবক্ষ মূর্তি আর পাশেই বড় ফলকে মাথিনের প্রেমের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। কূপটি ঢেকে রাখা হয়েছে তারের একটি জালি দিয়ে।
মাথিনের কূপ সংরক্ষণের উদ্যোক্তা আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘ঘটনাটি সত্য প্রেমের বেদনার্ত অধ্যায়। এই অধ্যায় তুলে ধরতে ১৯৮৪ সালে একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে মাথিনের কূপটি ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। এরপর ধীরে ধীরে তা আজকের রূপ পায়।’ প্রতিবছর ছয় থেকে সাত লাখের মতো পর্যটক মাথিনের কূপ দেখতে আসেন বলে জানান আব্দুল কুদ্দুস। অনেকের কাছে টেকনাফ মানেই এখন মাথিনের কূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত (ওসি) মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, মাথিনের কূপের আশপাশে নতুন করে বিভিন্ন ফুলের বাগান করা হচ্ছে। প্রতিবছর কূপটি দেখতে দেশি-বিদেশি বিপুলসংখ্যক পর্যটকের সমাগম ঘটে। কূপটি নানাভাবে সংস্কারের আওতায় নিয়ে এসে পর্যটকদের তীর্থস্থান হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে।
ধীরাজ ভট্টাচার্য ১৯০৫ সালে ৫ নভেম্বর ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় ইস্ট বেঙ্গলের যশোর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২৩-১৯২৪ সালের দিকে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে কক্সবাজারের টেকনাফে কর্মরত ছিলেন তিনি। টেকনাফ ত্যাগের পর পুলিশের চাকরি ছেড়ে ১৯২৫ সালে সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন ধীরাজ ভট্টাচার্য। তার অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি ‘সতীলক্ষী’। এ ছাড়া তার অভিনীত বেশ কয়েকটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। এরমধ্যে ১৯২৯ সালে ‘গিরিবালা’, ১৯৩০ সালে ‘কাল পরিণয়’ ও ‘মৃণালীনী’ এবং ১৯৩২ সালে ‘নৌকাডুবি’ সহ ৫৫টি ছবিতে অভিনয় করেছেন ধীরাজ। ১৯৫৮ সালে তার অভিনীত শেষ সিনেমাটি মুক্তি পায়, ছবিটির নাম ‘নীলাকঙ্গা’। চলচ্চিত্রের অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি দুটি আত্মজীবনীমুলক গ্রন্থও রচনা করেছেন। একটির নাম ‘যখন পুলিশ ছিলাম’, আরেকটি হলো ‘যখন নায়ক ছিলাম’।
আমারবাঙলা/এমআর