সুখ ব্যাপারটা বড়ই আপেক্ষিক। কে, কেন সুখী হবে, তা হয়তো মানুষ নিজেও জানে না। ধনসম্পদকে অনেক সময় সুখের চাবিকাঠি মনে করা হয়। তবে শুধু ধনসম্পদই মানুষকে সুখী করতে পারে না। সুখী হতে চাই উন্নত জীবনযাপন ব্যবস্থা। যে জীবনে থাকবে না নিরাপত্তার অভাব। থাকবে বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার ব্যবস্থা। জীবন হবে স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ।
এসব কিছুর জন্যই জাতিসংঘের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে ফিনল্যান্ড। অথচ গ্যালাপ ওয়ার্ল্ড পোল অনুসারে ১৪৩টি ধনীর দেশের তালিকায় ফিনল্যান্ড বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ নয়। এমনকি তালিকায় থাকা ২৫টির বেশি দেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় ফিনল্যান্ডের মানুষের গড় মাথাপিছু আয়ের চেয়ে বেশি। এ বছর জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে দশটি দেশ রয়েছে সবচেয়ে সুখীর তালিকায়। যুক্তরাষ্ট্রের মাসিক গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে এসব দেশ সম্পর্কে জানানো হয়েছে। দেখে নেওয়া যাক সুখী ১০ দেশের কথা।
১. ফিনল্যান্ড
টানা ষষ্ঠবারের মতো জাতিসংঘের সুখী দেশের তালিকায় প্রথম হয়েছে ফিনল্যান্ড। সেখানে মানুষের জীবনযাত্রার মান খুবই উন্নত। দেশটির সংস্কৃতি সমৃদ্ধ। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ফিনল্যান্ডে প্রতি বর্গকিলোমিটারে সবচেয়ে বেশি বন রয়েছে। ফিনল্যান্ডের মানুষেরা প্রকৃতি খুব ভালোবাসেন। প্রকৃতির সঙ্গে তাদের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। তাঁরা নিয়মিত হাঁটতে যান, সাঁতার কাটেন, সাইকেল চালান। এভাবে নিয়মিত ঘুরতে যাওয়া, প্রকৃতির সান্নিধ্য পাওয়া তাদের সুখী জীবনযাপনে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন দেশটির অনেক বাসিন্দা। ফিনল্যান্ডের নাগরিকেরা বাকি বিশ্বকে স্বার্থপর না হয়েও কীভাবে সুখী জীবন যাপন করা যায় সেই শিক্ষা দিতে পারেন।
২. ডেনমার্ক
ফিনল্যান্ডের মতো ডেনমার্কও টানা ষষ্ঠবার সুখী দেশের তালিকায় নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে। এবারও দেশটি তালিকায় দুই নম্বরে আছে। নর্ডিক প্রতিবেশী ফিনল্যান্ডের মতো ডেনমার্কেও মানুষ উচ্চমানের জীবনযাপন করেন।
দেশটির মানুষদের কর্মজীবন ভারসাম্যপূর্ণ, পরিবেশ উন্নত এবং তাঁরা উচ্চমানের স্বাস্থ্যসেবা উপভোগ করেন। ডেনমার্কে ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে সম্পদের ব্যবধান বিশ্বে সবচেয়ে কম। সেখানে এমন একটি সমাজব্যবস্থা চালু আছে যেখানে সবাই নানা সুযোগ-সুবিধা যেমন ভাগ করে নেন, তেমনি সব অসুবিধাও নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন।
৩. আইসল্যান্ড
নাগরিকদের উন্নত জীবনমান নিয়ে নানা বিবেচনায় (র্যাঙ্কিং) করা সব তালিকাতে সব সময়ই প্রথম সারিতে থাকে আরেক নর্ডিক দেশ আইসল্যান্ড। এ বছর জাতিসংঘের সুখী দেশের তালিকাতে আইসল্যান্ড তিন নম্বরে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের দেওয়া তথ্যানুযায়ী লিঙ্গ সমতা বিবেচনায় বিশ্বের সেরা দেশ আইসল্যান্ড। এ ছাড়া সবচেয়ে শান্তির দেশ হিসেবে টানা ১০ বছর শীর্ষে অবস্থান করছে আইসল্যান্ড। মনোমুগ্ধকর ভূপ্রকৃতির অধিকারী দেশটির নাগরিকদের খুব বেশি কর দিতে হয় না। সেখানে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। শিক্ষাও সম্পূর্ণ অবৈতনিক। আইসল্যান্ডের তিন লাখ ৯০ হাজার বাসিন্দা বই পড়তে ভালোবাসেন। আর ভালোবাসেন প্রকৃতি।
৪. সুইডেন
জাতিসংঘের সুখী দেশের তালিকায় গত বছর দুই ধাপ এগিয়ে চার নম্বরে উঠে এসেছে সুইডেন। সম্পদশালী এই দেশটির সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা খুবই শক্তিশালী। সুইডেনে সব প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি রয়েছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশটিতে কর্মজীবনে ভারসাম্য আগের তুলনায় অনেক উন্নত হয়েছে। অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় সুইডেনে একজন কর্মী বেতনসহ সবচেয়ে বেশি দিন ছুটি উপভোগ করতে পারেন। সেখানে বেতনসহ সর্বোচ্চ ৪১ দিন ছুটি কাটানো যায়। এ ছাড়া সুইডেনে সন্তান জন্মের পর তাকে লালন-পালনের জন্য বাবা-মা সর্বোচ্চ ৪৮০ দিন সবেতনে ছুটি নিতে পারেন। এই সময়ে তাদের বেতনের প্রায় ৮০ শতাংশ দেওয়া হয়। তবে দেশটিতে কর অনেক বেশি। সেখানে ব্যক্তিকে আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ কর দিতে হয়। অবশ্য সরকার এই রাজস্ব আয় জনগণের স্বার্থেই ব্যয় করে। সুইডেনে স্বাস্থ্য সেবা বিশ্বমানের, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিনা মূল্যে শিক্ষা দেওয়া হয়। লোকজনের দক্ষতা বাড়াতে সরকার থেকে নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যেন জনগণ চাকরির সুযোগ পান।
৫. ইসরায়েল
গাজায় হামাসের সঙ্গে এক বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ করছে ইসরায়েল। প্রতিবেশী লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সঙ্গে সদ্য একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেছে। তারপরও ইসরায়েল সুখী দেশের তালিকায় পাঁচ নম্বরে। ইসরায়েল অর্থনৈতিকদিক দিয়ে ধনী ও শক্তিশালী। এটি এদের সুখী হওয়ার অন্যতম কারণ।
৬. নেদারল্যান্ডস
এ বছর সুখী দেশের তালিকায় এক ধাপ পিছিয়ে গেছে নেদারল্যান্ডস। এর অর্থ এই নয় যে নাগরিকদের অভাব-অভিযোগ বেড়ে গেছে। বরং দেশটির বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ নেই। নেদারল্যান্ডসের জনগণ শিক্ষিত, জীবনযাত্রায় তাদের পছন্দ ও অপছন্দের প্রভাব রয়েছে।
৭. নরওয়ে
নরওয়ের মানুষেরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। তাঁরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতায় বিশ্বাস রাখেন। তাদের বিশ্বাস গণতন্ত্রের অভাবেই আয় এবং লিঙ্গবৈষম্য দেখা দেয়। তাঁরা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর আস্থাশীল। দেশটিতে মৃত্যুহার কম। কোভিড-১৯ মহামারির সময় লকডাউনজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতি দারুণভাবে কাটিয়ে উঠেছে। নরওয়েতে বিনা মূল্যে বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়।
৮. লুক্সেমবার্গ
দুর্গ, হ্রদ আর পাহাড়ের দেশ লুক্সেমবার্গ। মাত্র আট বছর আগেও সুখী দেশের তালিকায় ২০ নম্বরে ছিল দেশটি। ২০২০ সালে দেশটি শীর্ষ ১০ এ উঠে আসে। ছোট্ট এই দেশটিতে মাত্র সাত লাখ মানুষ বসবাস করেন। সেখানে মানুষ সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন, অন্যের ভালো থাকা বা অন্যকে ভালো রাখা তাদের কাছে গুরুত্ব পায়। জীবনে চলার পথ বেছে নেওয়া এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার স্বাধীনতা দেশটির নাগরিকদের রয়েছে। লুক্সেমবার্গ বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর একটিও বটে। সেখানে শ্রমিকদের বেতন মাসে ৭ হাজার ইউরো।
৯. সুইজারল্যান্ড
২০১৫ সালে সুখী দেশের তালিকায় এক নম্বরে ছিল সুইজারল্যান্ড। তারপর থেকে দেশটি ধাপে ধাপে পিছিয়ে গেছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে দেশটির মানুষেরা দুঃখী হয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা এখনো দুঃখ থেকে অনেক দূরে থাকা সুখী মানুষ। সুইজারল্যান্ডের ভূপ্রকৃতি মনোমুগ্ধকর, বাতাস বিশুদ্ধ। দেশটিতে শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বমানের।
সুইজারল্যান্ড সম্পদশালী দেশ এবং সেখানে সম্পদ বণ্টনে সমতা রয়েছে। চকলেট ও চিজের জন্য বিখ্যাত দেশটি কোনো যুদ্ধে কোনো ধরনের সহায়তা পাঠায় না। ১৮৪৭ সালের পর দেশটি আর কখনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি।
১০. অস্ট্রেলিয়া
২০১৮ সালের পর আবার সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষ দশে ফিরে এসেছে অস্ট্রেলিয়া। ইউরোপের বাইরে অস্ট্রেলিয়াই একমাত্র দেশ যারা সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষ দশে জায়গা করে নিয়েছে।
যদিও জীবন মূল্যায়নে অস্ট্রেলিয়া গতবারের চেয়ে এবার কম নম্বর পেয়েছে। তবে উচ্চ বেতন, উচ্চ কর্মসংস্থান এবং উচ্চ জীবন প্রত্যাশা দেশটিকে এগিয়ে দিয়েছে। সেখানে কর্মজীবনে স্বাস্থ্যকর ভারসাম্য রয়েছে। দেশটিতে আছে শক্তিশালী স্বাস্থ্যসেবা খাত এবং উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা। অস্ট্রেলিয়ার প্রাকৃতিক পরিবেশও বৈচিত্র্যময়।
আমার বাঙলা/ এসএ