শান্তিতে নোবেলজয়ী যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার আর নেই। স্থানীয় সময় রবিবার (২৯ ডিসেম্বর) বিকালে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের প্লেইনসে নিজ বাড়িতে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ১০০ বছর। জিমি কার্টারের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান কার্টার সেন্টার।
এক বিবৃতিতে জিমি কার্টারের ছেলে চিপ কার্টার বলেন, আমার বাবা একজন নায়ক ছিলেন। শুধু আমার কাছেই নন, যারা শান্তি, মানবাধিকার ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় বিশ্বাস করেন, এমন সবার কাছেই।
জিমি কার্টারকে ‘অসাধারণ নেতা’ আখ্যায়িত করে শোক প্রকাশ করেছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
জিমি কার্টার ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘজীবী প্রেসিডেন্ট। গত ১ অক্টোবরে জিমি কার্টার তার ১০০তম জন্মদিন উদযাপন করেন। এরপর ১৬ অক্টোবর ২০২৪ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে ভোট দেন। ই-মেইল যোগে আগাম ভোট দিয়েছিলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো প্রেসিডেন্টের চেয়ে সবচেয়ে দীর্ঘ আয়ুর অধিকারী কার্টার ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে নির্বাচিত হয়ে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী রোনাল্ড রিগ্যানের কাছে পরাজিত হয়ে হোয়াইট হাউস ছাড়েন তিনি।
জিমি কার্টার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় থাকাকালে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক দুর্দশা চলছিল। তার শাসনকালেই ইরানে মার্কিন দূতাবাসে যুক্তরাষ্ট্রের ৫২ জন কূটনীতিক ও নাগরিককে জিম্মি করা হয়েছিল। তিনি ক্ষমতা ছাড়ার পর এই জিম্মিদশার অবসান হয়। অবশ্য ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে কার্টারের ভূমিকা ছিল। এর মধ্য দিয়ে মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তিচুক্তি সম্ভব হয়।
জনপ্রিয়তা হারিয়ে হোয়াইট হাউস ছাড়ার পর মানবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজের সুনাম ফিরে পান জিমি কার্টার। এই কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০২ সালে তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
জর্জিয়ার প্লেইনস-এ ১৯২৪ সালের ১ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন জেমস আর্ল কার্টার জুনিয়র। পরবর্তী তিনি জিমি কার্টার হিসেবেই পরিচিতি পান। একজন কৃষক ও দোকানির চার সন্তানের একজন ছিলেন তিনি।
জিমি কার্টার যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল একাডেমি থেকে ১৯৪৬ সালে স্নাতক পাস করেন। এরপর পারমাণবিক সাবমেরিন কর্মসূচিতে কাজ করেন। পরবর্তীতে এই চাকরি ছেড়ে পরিবারের বাদাম চাষাবাদের ব্যবসা দেখভালের দায়িত্ব নেন।
কিশোর বয়স থেকেই সাউদার্ন ব্যাপ্টিস্ট সানডে স্কুলের শিক্ষক ছিলেন জিমি কার্টার। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনেও শক্তিশালী নৈতিকতার চেতনা নিয়ে আসেন তিনি। কোনো রাখঢাক ছাড়াই নিজের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিষয়টি প্রকাশ করতেন জিমি কার্টার।
জিমি কার্টার একপর্যায়ে কোটিপতি হন। জর্জিয়া থেকে কংগ্রেস সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জর্জিয়ার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান। ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডকে হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
১৯৪৬ সালে রোসালিন স্মিথকে বিয়ে করেন জিমি কার্টার। রোসালিনের সঙ্গে জিমি কার্টারের দাম্পত্য জীবন ছিল দীর্ঘ ৭৭ বছরের। গত বছরের নভেম্বরে ৯৬ বছর বয়সে মারা যান রোসালিন। স্ত্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে হুইলচেয়ারে বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল অসুস্থ কার্টারকে। তাদের সংসারে চার সন্তান, ১১ নাতি-নাতনি এবং ১৪ জন প্রপৌত্র ও প্রপৌত্রী রয়েছে। ২০১৫ সালে তাদের এক নাতির মৃত্যু হয়।
জিমি কার্টার কয়েক বছর ধরে ত্বকের ক্যানসার মেলানোমাসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। তার যকৃৎ ও মস্তিষ্কেও ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ে। তিনি আনুষ্ঠানিক কোনো চিকিৎসা না নিয়ে গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে বাকি জীবন কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর থেকে নিজ বাসভবনে নিবিড় সেবাযত্নে ছিলেন সাবেক এই প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের স্মৃতিকথা থেকে শুরু করে শিশুসাহিত্য— দুই ডজনেরও বেশি বই লিখেছেন জিমি কার্টার। ধর্মীয় বিশ্বাস ও কূটনীতি নিয়েও তিনি লেখালেখি করেছেন। ২০১৮ সালে তার ‘ফেইথ: আ জার্নি ফর অল’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
আমারবাঙলা/এমআরইউ