যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আজ মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর)। নির্বাচনকে নিয়ে বিশ্ববাসীর আগ্রহের কমতি নেই। গোটা বিশ্বের নজর এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে। তুমুল হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস দিচ্ছে সব জরিপ। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের সব সুইং স্টেটে জনমত জরিপে কমলা হ্যারিসের চেয়ে এগিয়ে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অবশ্য সবকিছুর নিয়ন্তা হতে পারে ইলেকটোরাল ভোট- এমনই মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। অনেকের আবার মত, দোদ্যুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলো ফলাফল ঠিক করে দেবে।
নির্বাচনে সাবেক প্রেসিডেন্ট ও রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী কমলা হ্যারিসের মাঝে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। নির্বাচনে প্রার্থী মোট ছয় জন। বাকিরা হলেন- গ্রিন পার্টির জিল স্টেইন, লিবার্টিয়ানের চিজ অলিভার, সোশ্যালিস্ট অ্যান্ড লিবারেশনের ক্লাউডিয়া দে লে ক্রুজ, কনস্টিটিউশনের র্যান্ডেল টেরি ও স্বতন্ত্র থেকে কর্নেল ওয়েস্ট।
আজ ভোটের মাধ্যমে মার্কিন জনগণ বলে দেবেন- এবারের নির্বাচনে চমক দেখিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হবেন? নাকি ইতিহাস সৃষ্টি করে কমলা হ্যারিস প্রথম মার্কিন নারী প্রেসিডেন্ট হবেন? এ নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে তার দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হবে ৭৮ বছর বয়সে। অপরদিকে কমলা হ্যারিসের বয়স ৬০ বছর।
ট্রাম্প ও কমলা দ্বৈরথের মাঝে অনেক কিছু দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে বিশ^ব্যাপী যুদ্ধ ও এতে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডেমোক্র্যাটিক জো বাইডেনের সমর্থন কমলাকে বিপাকে ফেলতে পারে বলে মনে করেন অনেকে। কারণ কমলা বাইডেন সরকারের বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট। অন্যদিকে আমেরিকার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশের প্রেসিডেন্ট পদে নারীকে ভোটাররা চাইবেন কিনা এটিও দেখার বিষয় বলে অনেকের ভাবনা। আবার নারী এবং আফ্রিকা ও ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভুত বলে তিনি সুবিধা পাবেন। সব নিয়ে এক অদ্ভুত সমীকরণে দাঁড়িয়ে আছে এ নির্বাচনের ফলাফল।
দোদুল্যমান সব অঙ্গরাজ্যেই এগিয়ে ট্রাম্প
নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর ‘সুইং স্টেট’ বা দোদুল্যমান রাজ্য হিসেবে পরিচিত। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ৫০টি স্টেটে একসঙ্গে ভোট হলেও মূলত সবারই নজর থাকে সুইং স্টেটের দিকে।
সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, অ্যাটলাস ইন্টেল পরিচালিত জরিপের তথ্য বলছে- যুক্তরাষ্ট্রের সব সুইং স্টেটে জনমত জরিপে কমলা হ্যারিসের চেয়ে এগিয়ে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
জরিপে প্রায় ৪৯ শতাংশ উত্তরদাতারা বলেছেন- তারা আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দেবেন।
সবশেষ জরিপ অনুযায়ী, সুইং স্টেটগুলোতে ডেমোক্র্যাট কমলা হ্যারিসের চেয়ে এক দশমিক আট শতাংশ ভোটে এগিয়ে আছেন ট্রাম্প।
নভেম্বরের প্রথম দুই দিনে পরিচালিত এই জরিপে অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রের আড়াই হাজার ভোটার। অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই ছিলেন নারী।
সুইং স্টেটগুলোতে চালানো আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাদা, নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসিলভেনিয়া এবং উইসকনসিনে জয় পাবে রিপাবলিকানরা।
অ্যারিজোনায় ট্রাম্পের পক্ষে ভোট পড়েছে ৫১ দশমিক নয় শতাংশ। অপরদিকে হ্যারিসের পক্ষে ভোট পড়েছে ৪৫ দশমিক এক শতাংশ। নেভাদায় আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণ কাকে ভোট দেবে জানতে চাইলে ৫১ দশমিক চার শতাংশ ভোটার ট্রাম্পকে পছন্দ করেছেন এবং ৪৫ দশমিক নয় শতাংশ ভোটার কমলাকে ভোট দিয়েছেন। নর্থ ক্যারোলাইনায় ট্রাম্প ৫০ দশমিক চার শতাংশ ভোট পেয়েছেন এবং কমলা পেয়েছেন ৪৬ দশমিক আট শতাংশ ভোট।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সুইং স্টেটগুলো। এসব রাজ্যে প্রার্থীদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয় এবং সেগুলোর ফলাফল আগে থেকে অনুমান করা অনেক কঠিন।
এ বছর সাতটি অঙ্গরাজ্যকে সুইং স্টেট বলা হচ্ছে। সেগুলো হলো- অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাদা, নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিন।
হোয়াইট হাউসে জয়ী হওয়ার জন্য আলোচিত দুই প্রার্থী কমলা ও ট্রাম্পের মধ্যে কে ২৭০টি ইলেক্টোরাল ভোট পাবেন তা নির্ধারণ করবে এই সাতটি সুইং স্টেট। এই স্টেটগুলোর মোট ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট সংখ্যা ৯৩।
ইলেকটোরাল কলেজ ভোট, হোয়াইট হাউজের চাবি
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থীই যে জয়ী হবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। একজন প্রার্থী তুলনামূলক কম ভোট পেয়েও প্রেসিডেন্ট হতে পারেন।
এর মূলে আছে দেশটির নির্বাচন ব্যবস্থায় ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ নামের ২০০ বছর পুরনো একটি বিশেষ পদ্ধতি। এই ইলেকটোরাল কলেজে যিনি ভালো ফল করেন তার হাতেই যায় হোয়াইট হাউসের চাবি। এ নির্বাচন ব্যবস্থায় ভোটারদের সরাসরি ভোটে না বরং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন পরোক্ষ ভোটে।
দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হতে প্রার্থীকে সাধারণত দুই ধরনের ভোটে জিততে হয়। এর একটি নাগরিকদের সরাসরি ভোট, যা পপুলার ভোট হিসেবে পরিচিত; আরেকটি হচ্ছে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট। এই দুটির মধ্যে ইলেকটোরাল কলেজের ভোটেই প্রার্থীর চূড়ান্ত জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়।
এ ব্যবস্থায় প্রার্থীদের জয়-পরাজয় জাতীয়ভাবে না হয়ে নির্ধারিত হয় একেকটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনী লড়াইয়ের মাধ্যমে। দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো অঙ্গরাজ্যে পপুলার ভোটে জয়ী হওয়ার অর্থ একজন প্রার্থী সেই অঙ্গরাজ্যের সব ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাবেন।
চার বছর আগে ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রার্থী জো বাইডেন নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হেরেছিলেন। ওই নির্বাচনে বাইডেন ৩০৬টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হন। হেরে যাওয়া ট্রাম্প পেয়েছিলেন ২৩২টি ইলেকটোরাল ভোট।
বাইডেন আট কোটি ১২ লাখের বেশি পপুলার ভোট পেয়েছিলেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর পাওয়া সর্বোচ্চ ভোট। এর বিপরীতে ট্রাম্প পেয়েছিলেন সাত কোটি ৪২ লাখের বেশি ভোট।
কিন্তু এর আগেরবার ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে ৩০ লাখের বেশি পপুলার ভোট পেলেও ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে হেরে পরাজিত হয়েছিলেন।
কী এই ইলেকটোরাল কলেজ?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটাররা তাদের ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে একদল কর্মকর্তাকে নির্বাচিত করে থাকেন, তাদের বলা হয় ইলেকটর। এই ইলেকটররাই নির্বাচকের ভূমিকা পালন করেন। একটি রাজ্যের ইলেকটরদের একসঙ্গে ইলেকটোরাল কলেজ বলা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্য ও রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিসহ (ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া) দেশটিতে মোট ইলেকটোরাল কলেজ ৫১টি। এই ইলেকটোরাল কলেজই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষের ভূমিকা পালন করে।
এক একটি রাজ্যে ইলেকটরের সংখ্যা একেকরকম। এটি নির্ধারিত হয় মার্কিন কংগ্রেসে রাজ্যের কতজন প্রতিনিধি ও সিনেটর আছেন সে হিসেবে। জনসংখ্যার ওপর রাজ্যগুলোর প্রতিনিধির সংখ্যা নির্ভর করে, প্রতি ১০ বছর পর পর আদমশুমারির মাধ্যম এটি নির্ধারণ করা হয়। এতে ১০ বছর পর পর অঙ্গরাজ্যগুলোর ইলেকটরের সংখ্যারও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে।
সাংবিধানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের দুই কক্ষে থাকা আসনের (প্রতিনিধি পরিষদে ৪৩৫, সিনেটে ১০০) বিপরীতে রাজ্যগুলো তাদের জন্য নির্ধারিত ইলেকটর পায়। কংগ্রেসে রাজধানী অঞ্চল ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার কোনো প্রতিনিধি না থাকলেও সেখান থেকে আসেন তিনজন ইলেকটর।
নির্বাচনের দিন ভোটাররা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিলেও আসলে তারা ৫১টি ইলেকটোরাল কলেজের ৫৩৮ জন ইলেকটর নির্বাচিত করে তাদের হাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দায়িত্ব তুলে দেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে একজন প্রার্থীকে এই ৫৩৮ ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে অন্তত ২৭০টি নিশ্চিত করতে হয়। অর্ধশত রাজ্য ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার ৫৩৮ ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে ২৭০টি পেলেই হাতে আসে হোয়াইট হাউজের চাবি।
কোন রাজ্যে কত ইলেকটোরাল ভোট
২০২০ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এবারও সবচেয়ে বেশি ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ায়, ৫৪টি। এরপর রয়েছে টেক্সাস ৪০, ফ্লোরিডায় ৩০, নিউ ইয়র্ক ২৮, ইলিনয় ও পেনসিলভানিয়ায় ১৯টি করে।
এ ছাড়া ওহাইওতে ১৭, জর্জিয়ায় ১৬ ও নর্থ ক্যারোলাইনায় ১৬, মিশিগান ১৫, নিউ জার্সিতে ১৪, ভার্জিনিয়াতে ১৩, ওয়াশিংটনে ১২, আরিজোনা, টেনেসি, ম্যাসাচুসেটস ও ইন্ডিয়ানায় ১১, মিনেসোটা, উইসকনসিন, ম্যারিল্যান্ড, মিজৌরি ও কলোরাডোতে ১০, অ্যালবামা ও সাউথ ক্যারোলাইনায় নয়, কেন্টাকি, অরেগন ও লুইজিয়ানায় আট, কনেটিকাট ও ওকলাহোমায় সাত, মিসিসিপি, আরকানস, ক্যানজাস, আইওয়া, নেভাডা ও ইউটায় ছয়; নিউ মেক্সিকো ও নেব্রাস্কায় পাঁচ; ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, নিউ হ্যাম্পশায়ার, মেইন, রোড আইল্যান্ড, আইডাহো ও হাওয়াইতে চার; মন্টেনা, নর্থ ডেকোটা, ভার্মন্ট, ডেলাওয়ার, ওয়াইওমিং, সাউথ ডেকোটা, আলাস্কা ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ায় তিনটি করে ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে।
উইনার-টেইক-অল
বেশিরভাগ রাজ্যে নিয়ম হল- ‘উইনার-টেইক-অল’। মানে কোনো রাজ্যে যদি দশটি ইলেকটোরাল ভোট থাকে, তার মধ্যে যে দল অন্তত ছয়টি, অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ ইলেকটোরাল ভোট পাবে, ওই রাজ্যের সবগুলো অর্থাৎ দশটি ইলেকটোরাল ভোটই সেই দলের বলে গণ্য হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৮টি রাজ্য ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ায় এই নিয়ম অনুসরণ কর হয়। কিন্তু নেব্রাস্কা ও মেইন রাজ্যে ‘উইনার-টেইক-অল’ নিয়ম অনুসরণ করা হয় না, এখানে প্রার্থীদের পাওয়া ভোটের অনুপাতে ইলেকটোরাল ভোট ভাগ করে দেওয়া হয়।
জনগণের সরাসরি ভোটে এগিয়ে থেকেও ইলেকটোরাল ভোটে হেরে যাওয়ার নজির আছে যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ভোটের হিসাবে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হিলারি রিপাবলিকান ট্রাম্পের চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ ভোট বেশি পেলেও ইলেকটোরাল ভোটের হিসাবে হেরে যান।
তার আগে ২০০০ সালে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী আল গোরের কাছে সরাসরি ভোটে হেরে যাওয়ার পরও রিপাবলিকান প্রার্থী জর্জ ডব্লিউ বুশ ইলেকটোরাল ভোটে জিতে হোয়াইট হাউজের টিকেট পেয়েছিলেন।
কেন এই পদ্ধতি?
১৭৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান যখন প্রণয়ন করা হয় তখন একটি জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা বাস্তবে অসম্ভব ছিল। এর কারণ ছিল দেশটির আয়তন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার পশ্চাৎপদতা।
আর যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রণেতারা চাননি রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে থাকা আইনপ্রণেতাদের হাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ুক। তারা এই ক্ষমতা দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে তুলে দিতে চাইলেন।
তাই সংবিধান প্রণেতারা ইলেকটোরাল কলেজ সৃষ্টি করলেন, প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে ইলেকটর দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভূমিকা রাখার সুযোগ দেওয়া হল।
সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বেশি জনসংখ্যার অঙ্গরাজ্যগুলো এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করবে এই বিবেচনায় প্রতিটি রাজ্যে অন্তত তিনজন ইলেকটর থাকার নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়। ইলেকটরের এই ন্যূনতম সংখ্যা অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার আকারের ওপর নির্ভর করে না। তবে এর বেশি ইলেকটরের সংখ্যা অঙ্গরাজ্যগুলোর জনসংখ্যার অনুপাত বিবেচনায় নির্ধারিত হয়।
দেশজুড়ে ভোটে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চেয়ে এ পদ্ধতিতে ছোট অঙ্গরাজ্যগুলোর বেশি বক্তব্য রাখার সুযোগ থাকায় তারা ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি সমর্থন করল।
ইলেটোরাল ভোটের সংখ্যা অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার আকারের ভিত্তিতে নির্ধারিত হত বিধায় দক্ষিণাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্যগুলো সরাসরি ভোটের চেয়ে এ পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেশি প্রভাব রাখার সুযোগ পাওয়ায় তারাও এ পদ্ধতি সমর্থন করল।
কারণ এখানে জনসংখ্যার বড় একটি অংশ ছিল দাসরা। দাসদের ভোটাধিকার না থাকলেও আদমশুমারিতে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের তিন-পঞ্চমাংশ ধরে তাদেরও গণনা করা হত।
যদি কোনো প্রার্থীই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পান তাহলে কী হবে?
এরকম কোনো পরিস্থিতি হলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী অনুযায়ী কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ- প্রতিনিধি পরিষদে ভোটাভুটির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবে আর সিনেট ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এ পর্যন্ত মাত্র একবার এমনটি ঘটেছিল। ১৮২৪ সালে চার জন প্রার্থীর মধ্যে ইলেকটোরাল ভোট ভাগাভাগি হওয়ার পর তাদের মধ্যে কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।
কিন্তু বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পদ্ধতিতে দুই রাজনৈতিক দলের আধিপত্য তৈরি হওয়ায় এখন আর তেমনটি হবে না বলে ধরে নেওয়া হয়।
ইলেকটোরাল ভোটের অসম বণ্টন
যদিও একটি রাজ্যের ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যায় সেই রাজ্যের জনসংখ্যার প্রতিফলন ঘটে, কিন্তু রাজ্যপ্রতি অন্তত তিনটি ভোট থাকার নিয়মের কারণে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ইলেকটোরাল ভোটের আপেক্ষিক প্রতিনিধিত্বের মান বিভিন্ন হয়।
এই নিয়মের কারণে নর্থ ও সাউথ ডাকোটা এবং নিউ ইংল্যান্ডের ছোট রাজ্যগুলো তাদের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর তুলনায় বেশি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে গেছে। অপরদিকে ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস ও ফ্লোরিডার মতো বেশি জনসংখ্যার রাজ্যগুলো তুলনামূকভাবে কম ইলেকটোরাল ভোটের অধিকারী।
ওয়াইওমিংয়ের প্রতি এক লাখ ৯২ হাজার লোকের জন্য একটি ইলেকটোরাল ভোট আছে, তুলনায় ক্যালিফোর্নিয়ার প্রতিটি ইলেকটোরাল ভোট সাত লাখ ২০ হাজার নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করছে। এর অর্থ ক্যালিফোর্নিয়ার একটি ইলেকটোরাল ভোট ওয়াইওমিংয়ের একটি ভোটের তিনগুণেরও বেশি লোকের প্রতিনিধিত্ব করছে। সারা দেশজুড়েই এই অসমতা বিরাজমান।
ভোটের ফল কখন পাওয়া যাবে?
প্রতিটি ভোট গণনা করতে কয়েক দিনও লেগে যেতে পারে। তবে সাধারণত যেদিন ভোট হয়, তার পরের দিন সকালেই জয়ী কে তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
২০১৬ সালে নির্বাচনে জয়ের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প রাত ৩টাতেই নিউ ইয়র্কের মঞ্চে সমর্থকদের সামনে বিজয়ীর ভাষণ দিতে উঠেছিলেন। কিন্তু ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চার দিন পর নিশ্চিত হয় জো বাইডেন হোয়াইট হাউজে যাচ্ছেন।
কেবল কি প্রেসিডেন্টই নির্বাচিত হচ্ছেন?
নির্বাচনের সব মনোযোগ ট্রাম্প না হ্যারিস জিতছেন, তার ওপর নিবদ্ধ থাকলেও এই নির্বাচনে ভোটাররা আসলে প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি কংগ্রেসের নতুন সদস্যদেরকেও বেছে নেবেন। একইদিন অঙ্গরাজ্যগুলোর গভর্নর ও আইন পরিষদ নির্বাচনের ভোটও গ্রহণ করা হবে।
মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ রিপাবরিকানদের নিয়ন্ত্রণে আছে। তারা এবারের নির্বাচনে তা ধরে রাখার পাশাপাশি সিনেটেও নিয়ন্ত্রণও করায়ত্ব করার চেষ্টা করবে। অপরদিকে ডেমোক্র্যাটরা সিনেটের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার পাশাপাশি প্রতিনিধি পরিষদে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে।
দুই কক্ষেই রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারলে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যদি ডেমোক্র্যাট হন, সেক্ষেত্রে তার পরিকল্পনায় বাধ সাধা কিংবা তাতে বিলম্ব ঘটাতে পারবে কংগ্রেস।
প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ আসনের সবগুলোতে এবং সিনেটের ১০০ আসনের মধ্যে ৩৩টিতে এ বছর ভোট হচ্ছে।
জয়ী প্রার্থী দায়িত্ব নেবেন কখন?
নির্বাচনে কমলা হ্যারিস বা ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হলেই যে সঙ্গে সঙ্গে আগের প্রেসিডেন্টের স্থলাভিষিক্ত হবেন, তা নয়। কারণ, নতুন নেতাকে মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী নিয়োগ করা এবং অন্যান্য পরিকল্পনার জন্য কিছুটা সময় নিতে হয়।
এরপরই নতুন প্রেসিডেন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নিতে পারেন। সাধারণত এই শপথ হয় ২০ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে। শপথ অনুষ্ঠানের পরই নতুন প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউজে যান চার বছর মেয়াদে দায়িত্ব পালনের জন্য।
আমারবাঙলা/এমআরইউ