আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইউরোপে সুরক্ষা খুঁজতে আসা বাস্তুচ্যুতরা কখনও কখনও তাদের জাতিগত পরিচয়ের কারণে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। ইউরোপের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থা কাউন্সিল অব ইউরোপ তাদের সবশেষ প্রতিবেদনে এ কথা বলেছে। বাস্তুচ্যুত মানুষের প্রতি ‘বিদ্বেষপূর্ণ’ রাজনৈতিক বক্তব্য এবং ইহুদি-বিরোধী ও মুসলিম-বিরোধী কর্মকাণ্ডের উত্থানের বিষয়েও উদ্বিগ্ন কাউন্সিল অব ইউরোপ।
বৃহস্পতিবার (২০ জুন) বর্ণবাদ ও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে কাউন্সিল অব ইউরোপ কমিশনের (ইসিআরআই) বার্ষিক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়েছে, ইউরোপে সুরক্ষা খুঁজতে আসা মানুষের জন্মস্থান, গায়ের রঙ এবং ধর্মের ভিত্তিতেই তাদের সঙ্গে আচরণ করা হয়।
প্রতিবেদনে ‘ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আসা বাস্তুচ্যুত মানুষদের’ আশ্রয় দেওয়ার প্রশংসনীয় প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানানো হয়েছে। কিন্তু ইউক্রেনীয়দের তুলনায় ‘আন্তর্জাতিক সুরক্ষা পাওয়া অন্যান্য দেশের মানুষের’ জন্য অভ্যর্থনা ব্যবস্থার মানের ক্ষেত্রে ‘দৃশ্যত পার্থক্য’ থাকায় এর সমালোচনা করেছে কাউন্সিল অব ইউরোপ।
‘ইউরোপের বাইরে থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য’ ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু সদস্য রাষ্ট্রে আশ্রয় চাওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত করা হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে পর্যবেক্ষণ সংস্থাটি। ইসিআরআই জানিয়েছে,‘যুদ্ধ এবং অন্যান্য জরুরি অবস্থার কারণে বাস্তুচ্যুত সব মানুষকে দ্রুত সুরক্ষা দেয়া উচিত।’
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া আক্রমণ শুরু করার পর ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আসা তৃতীয় দেশের নাগরিকদের সঙ্গে করা আচরণেরও সমালোচনা করেছে বিভিন্ন এনজিও এবং জাতিসংঘের সংস্থাগুলো।
রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করার কয়েকদিন পর অস্থায়ী সুরক্ষা নির্দেশিকা (টিপিডি) কার্যকর করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর মধ্য দিয়ে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে অস্থায়ী সুরক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়। টিপিডি কার্যকর করার কারণে লাখো ইউক্রেনীয় খুব দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা, কল্যাণ সুবিধা, আবাসন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন।
এটি ইউক্রেনীয়দের স্থানীয় নাগরিকদের মতো প্রায় সমান অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু তৃতীয় দেশের নাগরিকরা, যারা ইউক্রেন থেকেও পালিয়ে এসেছেন, তাদের এই সুযোগ দেওয়া হয়নি।
৫৪-পৃষ্ঠার ইসিআরআই রিপোর্টে আরো দেখা গেছে, কাউন্সিল অব ইউরোপের সদস্য রাষ্ট্রগুলোতেও ‘অভিবাসী-বিরোধী বিবৃতি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।’
আইসিআরআই জানিয়েছে, রাজনীতিবিদেরা যখন অভিবাসীদের বিরুদ্ধে একটি প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করতে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রাখেন, তখন নতুন আসা আশ্রয়প্রার্থীদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসাবে দেখা হয়। রাজনীতি ও নির্বাচনে সুবিধা পেতেই এ ধরনের বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেওয়া হয় বলেও মনে করছে কাউন্সিল অব ইউরোপ।
ইসিআরআই বলছে, বাস্তুচ্যুত ইউক্রেনীয়দের ক্ষেত্রে সংহতি এবং সমর্থনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, ইউরোপের কোথাও কোথাও স্থানীয়রা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যার মুখে পড়ার পর বেশ কয়েকটি ইউক্রেনীয় বিরোধী ঘৃণার ঘটনাও ঘটেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে ইউরোপের কয়েকটি দেশে ‘তীব্রভাবে ইহুদি বিদ্বেষ বেড়েছে।’ এ নিয়ে উদ্বেগও জানিয়েছে সংস্থাটি। হামাসকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি দেশে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
ইহুদি বিদ্বেষের পাশাপাশি ‘মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণার’ ঘটনাও ‘উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে’ জানিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে কাউন্সিল অব ইউরোপ।
ইসিআরআই চেয়ারম্যান বার্টিল কটিয়ার বলেন, ‘‘আমরা ইউরোপীয় সমাজে তথাকথিত ইসলামিকরণের হুমকিকে সম্পূর্ণ নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করে প্রকাশ্য বিতর্কের অসংখ্য ঘটনা লক্ষ্য করেছি।’’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ‘‘দৃশ্যমান ধর্মীয় প্রতীক বা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা ব্যক্তিদের কখনও কখনও সন্ত্রাসবাদ বা চরমপন্থার সঙ্গে যুক্ত হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এটি বিশেষ করে কিছু দেশে মুসলিম শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে।’’
বর্ণবাদ, ইহুদিবিদ্বেষ, জেনোফোবিয়া এবং হোমোফোবিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে বর্ণবাদ এবং অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে ইউরোপীয় কমিশন। কাউন্সিল অব ইউরোপের সদস্য রাষ্ট্রগুলোই কমিশনের সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছে।
এই কমিটি নিয়মিতভাবে কাউন্সিল অব ইউরোপের ৪৬টি দেশের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে সুপারিশ তুলে ধরে। কাউন্সিল অব ইউরোপ আইসল্যান্ড থেকে জর্জিয়া পর্যন্ত ৪৬টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত এবং এর লক্ষ্য মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের ভিত্তিতে ঐক্য তৈরি করা। ইনফোমাইগ্রেন্টস।
এবি/এইচএন