বিশ্বে নতুন নতুন ধর্মের উত্থান হয় এবং তা ছড়িয়ে পড়ে। একইসঙ্গে বাড়ে অনুসারীর সংখ্যা। একইভাবে একেক ধর্মের অনুসারীদের জন্ম হয় মৃত্যুও হয়। অনেক সময় অনুসারীরা ধর্মান্তরিত হন। ফলে বিশ্বে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বদল হয়।
পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মের একটি জরথুস্ত্রীয় বা জরাথ্রুস্টবাদ বা জুরোস্ট্রিয়ানিজম। প্রায় চার হাজার বছর আগে পারস্যে (বর্তমান ইরান) এ ধর্মের যাত্রা শুরু হয়। এ ধর্মে এক ঈশ্বরের কথা বলা আছে। জরাথ্রুস্টবাদের অনুসারীসংখ্যা এখন হাতে গোনা। এভাবেই যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্ম ও বিশ্বাসের আবির্ভাব ঘটেছে এবং মানুষ সে ধর্ম ও বিশ্বাসের অনুসারী হয়েছে।
২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে কোন ধর্মের অনুসারী কত ছিল তা নিয়ে এ লেখা-
১. খ্রিষ্টধর্ম: বর্তমানে খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীসংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিশ্বজুড়ে প্রায় ২৫২ কোটি ১৪ লাখ ৬০ হাজার মানুষ এ ধর্ম অনুসরণ করেন। যিশুখ্রিষ্টের জীবন, শিক্ষা ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে এ ধর্মের জন্ম ও বিস্তার শুরু হয়। অনুসারীর সংখ্যা বিবেচনায় এটি যেমন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ধর্ম, তেমন ভৌগোলিকভাবে বিস্তারের দিক থেকেও এ ধর্মের প্রসার বেশি। এ ধর্মানুসারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ রোমান ক্যাথলিক গির্জাকে অনুসরণ করেন। রোমান ক্যাথলিকদের সর্বোচ্চ নেতা পোপ। এরপরই আছেন ইস্টার্ন অর্থোডক্স গির্জা ও প্রোটেস্ট্যান্ট গির্জার অনুসারীরা। খ্রিষ্টানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেল।
২. ইসলাম ধর্ম: অনুসারীর দিক দিয়ে বর্তমানে পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম ইসলাম। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ নবী ও রাসুল। ইসলাম আরবি শব্দ, এর আক্ষরিক অর্থ আত্মসমর্পণ (আল্লাহর আদেশ–নির্দেশের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা)। ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মুসলিম বলা হয়। ইসলাম ধর্মের মূল বক্তব্য, আল্লাহ হলেন একমাত্র স্রষ্টা এবং গোটা বিশ্বজগতের প্রতিপালক। তার কোনো অংশীদার নেই। তিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও রক্ষাকর্তা। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। বিশ্বে প্রায় ১৮৯ কোটি ৯১ লাখ তিন হাজার মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন।
৩. সনাতন ধর্ম: হাজার বছরের বেশি পুরোনো ধর্মের একটি সনাতন ধর্ম। অনুসারীসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ ধর্ম এটি। সনাতন ধর্মের উত্থান ভারতীয় উপমহাদেশে। বিভিন্ন দর্শন, বিশ্বাস ও বৈচিত্র্যময় আচার-অনুষ্ঠানের মিশেল দেখা যায় এ ধর্মে। উপমহাদেশ থেকে সনাতন ধর্ম ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকের দিকে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় সনাতন ধর্মের ব্যাপক প্রভাব ছিল। বর্তমানে সারা বিশ্বে এ ধর্মের অনুসারীসংখ্যা প্রায় ১০৯ কোটি ৫ লাখ ৯২ হাজার। অনেক পণ্ডিত মনে করেন যে সনাতন ধর্মের ঐতিহ্যের প্রাচীনতম উৎস সিন্ধু সভ্যতা (খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় সহস্রাব্দ) থেকে এসেছে।
৪. অজ্ঞেয়বাদ: অজ্ঞেয়বাদ অর্থ হচ্ছে, কোনো বিষয় সম্পর্কে নিজেদের জ্ঞান না থাকার স্বীকারোক্তি। অজ্ঞেয়বাদীদের মতে, ঈশ্বর বা এ–সম্পর্কিত বিষয়াদি সম্পর্কে যেহেতু মানুষের হাতে কোনো বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণনির্ভর জ্ঞান নেই, তাই এই বিষয়ে অজ্ঞেয়বাদীরা ধরে নেন যে তারা কিছু জানেন না। তাই তারা কোনো ঈশ্বরের প্রার্থনা না–ও করতে পারেন। আবার অনেক অজ্ঞেয়বাদী শক্তি এমনকি মানুষের আত্মায়ও বিশ্বাস করেন। সারা বিশ্বে প্রায় ৭৪ কোটি ৪১ লাখ ৬৬ হাজার মানুষ অজ্ঞেয়বাদী।
৫. বৌদ্ধধর্ম: গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা থেকে বৌদ্ধধর্ম ও মতবাদ গড়ে উঠেছে। ভারতীয় ভূখণ্ডের উত্তরে বসবাস করতেন গৌতম বুদ্ধ। ভারত থেকে মধ্য ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া, চীন, কোরিয়া ও জাপানে বৌদ্ধধর্মের বিস্তার ঘটে। এশিয়ার আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনে বৌদ্ধধর্মের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বৌদ্ধধর্ম পশ্চিমা বিশ্বেও বিস্তার লাভ করে। পালি, সংস্কৃতসহ প্রাচীন ভারতের কয়েকটি আনুষ্ঠানিক ভাষায় বৌদ্ধধর্মগ্রন্থ ও এর মতবাদ বিকশিত হয়েছে। বৌদ্ধদের ধর্মীয় গ্রন্থের নাম ত্রিপিটক। গ্রন্থটি পালি ভাষায় লেখা। এটি মূলত বুদ্ধের দর্শন ও উপদেশের সংকলন। বিশ্বে প্রায় ৫৩ কোটি ৬ লাখ ১২ হাজার মানুষ বৌদ্ধধর্মের অনুসারী।
৬. চীনা লোকজ ধর্ম: চীনা লোকজ ধর্ম ‘চীনা জনপ্রিয় ধর্ম’ নামেও পরিচিত। এ ধর্মকে একটি খালি বাটি হিসেবে বর্ণনা করা হয়, যা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ও সর্বজনীন ধর্ম যেমন বৌদ্ধধর্ম, তাওবাদ, কনফুসীয়বাদ, চীনা সমন্বিত ধর্মের বিষয়বস্তু দিয়ে পূর্ণ হতে পারে। এ ধর্মে রয়েছে শেন বা আত্মা ও পূর্বপুরুষদের পূজা করা, দানবীয় শক্তি বর্জন এবং প্রকৃতির যৌক্তিক নিয়মে বিশ্বাস। এই ধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, মহাবিশ্বের ভারসাম্য ও বাস্তবতা মানুষ ও তাদের শাসকদের পাশাপাশি আত্মা ও দেবতাদের মাধ্যমে প্রভাবিত হতে পারে। প্রায় ৪৫ কোটি ৭৬ লাখ ৭২ হাজার মানুষ এ ধর্মের অনুসারী।
৭. জাতিগত বা উপজাতীয় ধর্ম: জাতিগত বা উপজাতীয় ধর্ম এমন একটি ধর্মবিশ্বাস, যা বংশগতির ধারণা ও একটি নির্দিষ্ট জাতিসত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত। জাতিগত ধর্মগুলো প্রায়ই সর্বজনীন ধর্ম থেকে আলাদা, যেমন ইসলাম কিংবা খ্রিষ্টধর্ম জাতিগত, জাতীয় বা বর্ণগত পরিধিতে সীমাবদ্ধ নয়। এসব ধর্মের অনুসারী সর্বজনীন। সারা বিশ্বে বহু জাতি বা উপজাতির মানুষ ছড়িয়ে আছেন। তারা নিজ নিজ জাতিগত বিশ্বাসকে অনুসরণ করেন। বিশ্বে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৮ কোটি ৮০ লাখ ২২ হাজার।
৮. নাস্তিকতা বা নিরীশ্বরবাদ: নাস্তিকতা বা নিরীশ্বরবাদ এমন একটি বিশ্বাস, যেখানে কোনো ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না। পৃথিবীতে এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। প্রায় ১৪ কোটি ৭০ লাখ ৯ হাজার মানুষ ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না।
৯. নতুন ধর্মবাদী (এশিয়ায় নতুন ধর্মীয় আন্দোলন): নিউ রিলিজিয়াস মুভমেন্ট (এনআরএম) একটি নতুন ধর্ম। এ ধর্মীয় বিশ্বাস বা আধ্যাত্মিক দলের জন্ম আধুনিক যুগে। এনআরএম নতুন ধর্ম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে অথবা একটি বিস্তৃত ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ হতে পারে। অনেক এনআরএম অনুসারী দাবি করেন যে ধর্ম বলে কিছু নেই, সবই বৈজ্ঞানিক সত্য। সারা বিশ্বে প্রায় ছয় কোটি ৭৪ লাখ ৬৩ হাজার এনআরএম অনুসারী আছে।
১০. শিখধর্ম: পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগে ভারতীয় উপমহাদেশের পাঞ্জাব অঞ্চলে শিখ ধর্ম ও মতবাদ প্রতিষ্ঠা পায়। এ ধর্মের অনুসারীদের শিখ বলা হয়। শিখরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে গুরমাত বলেন। শিখ বিশ্বাস অনুযায়ী, ১৪৬৯ থেকে ১৫৩৯ সালে গুরু নানক শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন। গুরু নানকের পর আরো নয়জন গুরু তার উত্তরসূরি হয়েছেন। শিখ বিশ্বাস অনুযায়ী, এই ১০ মানবগুরুর সবাই একই আত্মা। দশম গুরু গোবিন্দ সিংয়ের (১৬৬৬ থেকে ১৭০৮) মৃত্যুর পর সব গুরুর একক আত্মা শিখদের পবিত্র গ্রন্থ গুরুগ্রন্থ সাহিবে প্রবেশ করেছে। বিশ্বব্যাপী শিখধর্মের আড়াই কোটির বেশি অনুসারী রয়েছে।
আমারবাঙলা/এমআরইউ