সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক

শত বছর আগের চিঠি ফিলিস্তিনিদের জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে আনে

আমার বাঙলা ডেস্ক

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের জনগণের মধ্যকার বিবাদ অনেক দিনের। এ দ্বন্দ্ব–সংঘাতের সূত্রপাত ১০০ বছরের বেশি আগে।

দীর্ঘ এ সময়ে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে কয়েক দফা যুদ্ধ বেধেছে। হয়েছে ‘ইন্তিফাদা’ নামে পরিচিত ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলবিরোধী অভ্যুত্থান, হয়েছে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের পাল্টা প্রতিশোধ ও দমনমূলক অভিযান।

নিজেদের ভূমি, সীমান্ত ও অধিকার নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের ঐতিহাসিক বিবাদের পরিণাম আজও টানতে হচ্ছে তাদের। এরই সাম্প্রতিকতম ফলাফল, ইসরায়েল ও গাজায় হামাসের মধ্যে চলা যুদ্ধ।

১৯৪৮ সালের আগে ইসরায়েল কী ছিল এবং কীভাবে এর সৃষ্টি: অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটেন ‘প্যালেস্টাইন’ (ফিলিস্তিন) নামে পরিচিত ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। মধ্যপ্রাচ্যের এই অংশ দীর্ঘকাল অটোমান শাসকদের অধীনে ছিল।

ফিলিস্তিনে আগে থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ আরব ও সংখ্যালঘু ইহুদিদের পাশাপাশি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করত।

ইহুদিদের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ এই আরব জনগোষ্ঠীর উত্তেজনা গভীর হয় তখন, যখন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার বালফোর ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর জায়নবাদী নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে একটি পত্র পাঠান। এর মধ্য দিয়ে তিনি ‘জায়নবাদ’ নামক উগ্র ইহুদিবাদ বা ইহুদি জাতীয়তাবাদকে স্বীকৃতি দেন। এটি এক মহাবিপর্যয়ের দুয়ার খুলে দেয়।

এ স্বীকৃতির মাধ্যমে ব্রিটেন নীতিগতভাবে সংখ্যালঘু ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্য ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে একটি ‘জাতীয় আবাস’ প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়। এই সম্মতি বা অঙ্গীকার কালক্রমে বালফোর ঘোষণাপত্র নামে পরিচিতি পায়।

এ ভূমির সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে ইহুদিদেরও একটা যোগসূত্র ছিল। কিন্তু ভূখণ্ডটির ওপর ফিলিস্তিনি আরবদের দাবি ছিল কয়েক শতকের পুরোনো। তারা ব্রিটেনের ওই উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান করেন। ওই তৎপরতার পক্ষে ব্রিটেন এ অজুহাত দাঁড় করায় যে ভূখণ্ডটিতে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি আরবদের অধিকার এমনিতেই সুরক্ষিত।

ব্রিটেনের মদদে ১৯২০–এর দশক থেকে ১৯৪০–এর দশকের মধ্যে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ইহুদিদের আগমন বেড়ে যায়। তাদের অনেকেই ইউরোপ থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানে পালিয়ে আসেন। ১৯৩৯-৪৫ সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল আর জার্মানিতে শাসক হিটলারের চরম ইহুদিবিদ্বেষ জায়নবাদীদের বড় সুযোগ এনে দেয়।

বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইউরোপে ৬০ লাখের মতো ইহুদি নিধন করা হয় (ইতিহাসে ‘হলোকাস্ট’ নামে পরিচিত)। বিশ্বযুদ্ধ শেষে এ হলোকাস্টকেই ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের একটা নিরাপদ ও স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা হিসেবে তুলে ধরা হয়। জায়নবাদী আন্দোলন ও হলোকাস্টের ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালের মধ্যে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ছয় লাখ ৩০ হাজারে; যা সেখানকার জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের কিছু বেশি।

ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইউরোপীয় ইহুদিদের স্রোত বাড়তে থাকায় একপর্যায়ে স্থানীয় ফিলিস্তিনি আরবদের সঙ্গে তাদের সংঘাত দেখা দেয়। ১৯৩৩ সালে ফিলিস্তিনিরা বড় আকারে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু করলে ব্রিটিশ সরকার কঠোরভাবে তা দমন করে। পাশাপাশি ফিলিস্তিনে স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের নানামুখী পরিকল্পনা ও কর্মকাণ্ড চলতে থাকে।

১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে সহিসংতা বেড়ে যাওয়া এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনকে ইহুদি ও আরব রাষ্ট্র— এ দুভাগে ভাগ করার পক্ষে ভোট দেয় জাতিসংঘ; যেখানে জেরুজালেমকে একটি আন্তর্জাতিক শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেওয়া হয়।

ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে শাসিত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ৫৬ শতাংশ ইহুদি ও ৪৩ শতাংশ ফিলিস্তিনি আরবদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার এ পরিকল্পনা কোনো আরব দেশ মেনে নেয়নি। তাদের যুক্তি ছিল, ইহুদিরা জনসংখ্যায় কম হলেও তাদের বেশি ভূখণ্ড দেওয়া হয়েছে পরিকল্পনাটিতে। সাধারণ পরিষদে ৩৩-১৩ ভোটে গৃহীত এ প্রস্তাবে চীনসহ ১০ দেশ ভোট দানে বিরত এবং থাইল্যান্ড অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকে।

ভোটাভুটিতে অনুপস্থিত থাকে ব্রিটেনও। এ পরিকল্পনা প্রত্যাহার করে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে জাতিসংঘের হাতে ফিলিস্তিন সমস্যা সুরাহার ভার তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দেশটি।

ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ওপর এভাবে ব্রিটিশ শাসন শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে সেখানকার ইহুদি নেতারা একটি স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্রের একতরফা ঘোষণা দেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান সঙ্গে সঙ্গে একে স্বীকৃতি দেন। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর অনিঃশেষ বিপর্যয় নেমে আসে। পরের বছর জাতিসংঘ ইসরায়েলকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়।

১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ: স্বাধীনতা ঘোষণার পরদিন ইসরায়েলকে আক্রমণ করে পাঁচ আরব দেশের সেনাবাহিনী। ইসরায়েলের কাছে এ যুদ্ধ হয়ে ওঠে স্বাধীনতাযুদ্ধ হিসেবে। ১৯৪৯ সালে এক অস্ত্রবিরতির মধ্য দিয়ে এ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। তবে ইতোমধ্যে ইসরায়েল ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের বেশির ভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

অস্ত্রবিরতি চুক্তি অনুযায়ী মিসর গাজা উপত্যকা, জর্ডান পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম এবং ইসরায়েল পশ্চিম জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

এর আগে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড থেকে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি আরব বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যান বা তাদের জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তাদের বাড়িঘরে বসতি গড়েন ইহুদিরা। এদিকে, বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ ফিলিস্তিনি হয়ে যান শরণার্থী।

এ ঘটনা ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘নাকবা’ (বিপর্যয়) হিসেবে পরিচিত। পরবর্তী বছরগুলোয় মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম–অধ্যুষিত দেশগুলো থেকে হাজার হাজার ইহুদি ইসরায়েলে পাড়ি জমান।

১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ: ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ ‘সিক্স–ডে ওয়ার’ (ছয় দিনের যুদ্ধ) নামেও পরিচিত। এ যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা বদলে দেয় এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।

ইসরায়েলের সঙ্গে এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে মিসর, সিরিয়া ও জর্ডান। মিসর ও সিরিয়ার কাছে থেকে হামলার শিকার হওয়ার আশঙ্কায় ইসরায়েল আগবাড়িয়ে মিসরের বিমান বাহিনীর ওপর হামলা চালালে এ যুদ্ধ বাধে।

যুদ্ধে মিসরের কাছ থেকে সিনাই উপদ্বীপ ও গাজা উপত্যকা, সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান মালভূমির বেশির ভাগ এবং জর্ডানের কাছ থেকে পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীর দখল করে নেয় ইসরায়েল। এর ফলে পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেমে বসবাসকারী প্রায় ১০ লাখ ফিলিস্তিনি ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

ইসরায়েলের এ দখলদারি টিকে আছে আজকের দিনটি পর্যন্ত। ইতোমধ্যে ইসরায়েল ১৯৭৯ সালে মিসরের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি করে এবং সিনাই উপদ্বীপ ফিরিয়ে দেয়। তবে ইসরায়েল অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেম ও গোলান মালভূমিকে পাকাপাকিভাবে তার অংশ করে নেয়। যদিও ইসরায়েলের এমন দখলদারিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বেশির ভাগই স্বীকৃতি দেয়নি।

গাজায় ইসরায়েল কী ঘটিয়েছে: দখলদার ইসরায়েল ছাড়া মিসর ও ভূমধ্যসাগরে ঘেরা ছোট উপত্যকা গাজা দৈর্ঘ্যে ৪১ কিলোমিটার (২৫ মাইল), প্রস্থে ১০ কিলোমিটার। গাজার অধিবাসী প্রায় ২৩ লাখ। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর একটি।

ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সাম্প্রতিকতম যুদ্ধ শুরুর আগেই গাজায় বেকারত্বের হার ছিল বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ। এখানকার অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতেন এবং বেঁচে থাকতেন বৈদেশিক খাদ্যসহায়তার ওপর।

গাজার এখনকার যে সীমান্ত, সেটি ১৯৪৮ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের ফল। তখন এটি মিসরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে মিসরের কাছ থেকে গাজার দখল ছিনিয়ে নেয় ইসরায়েল। সেখানে তারা নির্মাণ করে ইহুদি বসতি এবং গাজার ফিলিস্তিনিদের সামরিক শাসনের অধীনে নিয়ে আসে।

২০০৫ সালে ইসরায়েল একপক্ষীয়কভাবে এ উপত্যকা থেকে সেনা ও বসতি স্থাপনকারীদের প্রত্যাহার করে নেয়। যদিও অভিন্ন সীমান্ত, আকাশপথ ও উপকূলরেখার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কাছে রাখে। এর ফলে গাজার বাসিন্দাদের চলাচল এবং উপত্যকাটিতে পণ্য প্রবেশের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়ে যায় দেশটির হাতে।
গাজায় ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ যে মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত, তাতে জাতিসংঘ পর্যন্ত এ ভূখণ্ডকে ইসরায়েল-অধিকৃত এলাকা বলেই এখন পর্যন্ত বিবেচনা করে থাকে। তবে ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জিতে স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস গাজা উপত্যকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। তখন থেকে বারবারই ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাধীনতার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ছে হামাস।

সূত্র : বিবিসি।

আমারবাঙলা/এমআরইউ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি সংহতি-সমর্থনের আহ্বান গুড নেইবারস ওয়েলফেয়ারের

গুড নেইবারস ওয়েলফেয়ার অগানাইজেশন ফিলিস্তিনের জনগণে...

সরকার কোন মেডিক্যাল কলেজ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়নি-মহাপরিচালক

সরকার দেশের কোন মেডিকেল কলেজ বন্ধ করতে চায় না বা...

দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে মহাপরিচালকের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের...

বর্ষবরণ শোভাযাত্রা চলাকালে মেট্রোরেলের ২ স্টেশন বন্ধ থাকবে

বাংলা নববর্ষের দিন বর্ষবরণ শোভাযাত্রা চলাকালে (সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত)...

‘পাগলা চাচা শেখ হাসিনা কোথায়’ লেখা চিরকুট পাগলা মসজিদের দানবাক্সে

কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের দানবাক্সে অর্থ ও স্বর্ণা...

জয়পুরহাটে কারাগারে বসে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন এক শিক্ষার্থী

জয়পুরহাট জেলা কারাগার থেকে সিরাজুল ইসলাম (১৮) নামে...

দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে মহাপরিচালকের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের...

সরকার কোন মেডিক্যাল কলেজ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়নি-মহাপরিচালক

সরকার দেশের কোন মেডিকেল কলেজ বন্ধ করতে চায় না বা...

মিঠাপুকুরে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারে সেলিম এর নগদ অর্থ, খাবার প্রদান

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ৫নং বালার হাট ইউনিয়নের ক...

ফেনীর দাগনভূঞায় চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর মানববন্ধন

ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য শাহ...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা