ধূমপান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব ভয়াবহ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ধূমপান শরীরের এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই যার ক্ষতি করে না। নারীদের ক্ষেত্রে এটি নারীর গর্ভধারণ ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। ধূমপানের ফলে একজন নারী বন্ধ্যাত্বের শিকার হতে পারে, গর্ভপাত ঘটতে পারে, গর্ভের শিশুর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে, এমনকি সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মা অথবা শিশুর মৃত্যুও ঘটতে পারে।
বাংলাদেশে নারীদের মাঝে এখনো ধূমপানের ব্যবহার তুলনামুলক কম। তবু ৩০% নারী কর্মস্থলে ও ২১% নারী পাবলিক প্লেসে পরোক্ষ ধূমপানের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে (সূত্র: গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০১৭)। পাশাপাশি গৃহেও নারীরা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। বাসায় বাবা-ভাই-স্বামী’র ধূমপান, কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর ধূমপান, যানবাহনে ও পাবলিক প্লেসে অন্যদের ধূমপানের ফলে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হওয়ায় এ্যাজমা, স্তন এবং ফুসফুস ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির তথ্য মতে, যে সব নারী প্রতিদিন ১ ঘন্টা ধূমপায়ীর সাথে থাকে তাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ।
ধোঁয়াযুক্ত তামাকের ক্ষতির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত হলেও ধোঁয়াবিহীন তামাকের ক্ষতির সঙ্গে আমাদের পরিচিতি অনেক কম। অর্থাৎ সিগারেটের পাশাপাশি গুল, জর্দা, সাদাপাতা, চুরুট ইত্যাদি ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যাও কম নয়। নারীদের ক্ষেত্রে হিসেব করলে ধোঁয়াযুক্ত তামাক ব্যবহারকারী চেয়ে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারীই বেশি। ধোঁয়াবিহীন তামাকের দামও অনেক কম এবং সহজেই হাতের নাগালে পাওয়া যায়। ফলে নারীদের মধ্যে বিশেষ করে গ্রামের দরিদ্র্ এবং শিক্ষাবঞ্চিত নারীরা এতে সবচেয়ে বেশি আসক্ত। ধোঁয়াবিহীন তামাকে দুই হাজারের মতো রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা জীবনঘাতী রোগ ডেকে আনে। মুখের ক্যানসার, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকসহ অনেক জটিল রোগের জন্ম দেয় ধোঁয়াবিহীন এসব তামাক। এ ছাড়া গর্ভবতীদের গর্ভপাত, মায়ের মৃত্যুসহ সন্তান জন্ম দিতে জটিলতার জন্য দায়ী এসব তামাক।
আমাদের দেশের একটা বড় অংশ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে এবং তাদের প্রাত্যহিক আয় অনেক কম। তাদের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক আয়ের একটা বড় অংশ তামাকের পিছনে ব্যয় হওয়ায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০১৭ এর তথ্য মতে, তামাক ব্যবহারকারীরা তাদের মাসিক গৃহস্থালী খরচের ৫% তামাকের পেছনে ব্যয় করেন। সাধারণত পুরুষদের উপার্জিত অর্থের বড় অংশ তামাকের পিছনে ব্যয় করার ফলে প্রভাব পড়ে নারী, শিশুদের খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্যের উপর এবং ঘাটতি সৃষ্টি হয় মৌলিক চাহিদার উপর।
নারীরা শুধূমাত্র পরোক্ষ ধূমপানের কারণেই নয়, তামাক উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ সহ সকল কাজে নারীসহ শিশুদের সংযুক্ত করার কারণে তারা স্বাস্থ্যক্ষতিসহ বিভিন্ন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বিড়ি কারখানাগুলোতে পুরুষের পাশাপাশি স্বল্প মজুরীতে বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিকও কাজ করে। ফলে গর্ভধারনের ক্ষমতা হ্রাস, কম ওজনের বা মৃত শিশু বা অকাল প্রসবসহ নানারকম জটিল সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তারা।
নারীদের মধ্যে তামাকের ব্যবহারের এই ক্রমবর্ধমান সমস্যার সমাধান অতি জরুরী। তামাক কোম্পানিগুলো সারা বিশ্বে নারীদেরকে লক্ষ্যবস্তু করছে, নারীস্বাস্থ্যকে ক্রমবর্ধমানভাবে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী এই শতাব্দিতে ১ বিলিয়ন লোক তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে মারা যাবে। নারীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের মাত্রা কমিয়ে আনার মাধ্যমে অনেক জীবন রক্ষা করা যেতে পারে।
নারীদের উপর তামাকজাত দ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব রোধে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনে করা জরুরী। বাংলাদেশে বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) এর ৪নং ধারায় বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তি পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান করতে পারবে না’। কিন্তু বিভিন্ন পাবলিক প্লেস, যেমন-রেস্টুরেন্ট, গণপরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বিলুপ্তর কথা বলা হয়নি। ফলে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হওয়ার সুযোগ রয়েই গেছে। তাই একটি তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে এই বিদ্যমান আইনকে আরো শক্তিশালী ও বাস্তবমূখী করতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেশ কিছু সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সংশোধনী হলো- সকল পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র ও গণপরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বিলুপ্ত করা।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবগুলো হলো- বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা ও মোড়কবিহীন বিক্রয় নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির সকল সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে স্বাস্থ্যঝুঁকির চিত্র ৫০ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ৯০ ভাগ করা এবং ক্ষতিকর ই-সিগারেট ও ইমার্জিং প্রোডাক্ট এর ক্ষতি থেকে শিশু-কিশোরদের রক্ষা করতে জরুরি ব্যবস্থা নেয়া।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে প্রত্যাশা যে, নারীদের তামাকের ভয়াল ছোবল থেকে রক্ষা করতে এবং একটি তামাকমুক্ত সুস্থ-সবল জাতি গঠনের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন হবেন এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করতে প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো অতিদ্রুত পাস করে আইনে রূপদানের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন।
লেখক: নারী উদ্যোক্তা ও সদস্য, তামাকবিরোধী মায়েদের ফোরাম
আমারবাঙলা/জিজি