নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের লিফটে আটকে পড়ার ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ঘটনার অনুসন্ধানে নেমে অটোমেটিক রেসকিউ ডিভাইস (এআরডি) ও লিফট অপারেটরের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকাসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে ‘অবহেলা’র প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
মঙ্গলবার (২১ মে) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত কমিটি।
প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, দুর্ঘটনা কবলিত ১ হাজার কেজি ধারণ ক্ষমতার লিফটটি ‘মান বংলাদেশ লিমিটেড’ কর্তৃক সিগমা (ম্যানুফেকচার বাই ওটিআইসস এলিভেটর, কোরিয়া) ব্র্যান্ডের। ২০১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে লিফটটি উদ্বোধন করা হয়। এরপর থেকে প্রায় ১২ বছর যাবৎ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। লিফটটি নিরবচ্ছিন্ন পরিচালনার স্বার্থে চলতি অর্থবছরে মাসিক সার্ভিসিং এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একই প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা নিয়মিত সার্ভিসিং করছে।
তদন্ত কমিটির পরিদর্শনকালে লিফটটি চলাচলে কোনো সমস্যা পাওয়া না গেলেও লিফট সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির বক্তব্য ও অন্যান্য তথ্যাবলী পর্যালোচনা করে বেশ কিছু ত্রুটির তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। এগুলো হলো :
১. গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-৭, ঢাকার নির্বাহী প্রকৌশলী, সংশ্লিষ্ট উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (ই/এম) এবং সংশ্লিষ্ট উপ-সহকারী (ই/এম) এর লিফট রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের প্রতি নির্দেশ প্রদান করলেও যথাযথভাবে প্রত্যক্ষ কাজ তদারকিতে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়।
২. লিফট পরিচালনার জন্য স্থিতিশীল ভোল্টেজ সম্বলিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করার লক্ষ্যে স্থাপিত অটোমেটিক ভোল্টেজ রেগুলেটর (এভিআর) ডিভাইসটি অকেজো অবস্থায় রয়েছে।
৩. লিফট চলাচলের সময়ে কোনো কারণে বিদ্যুৎ চলে গেলে বা অন্য কোনো কারণে লিফট দুই ফ্লোরের মধ্যবর্তী স্থানে বন্ধ হয়ে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিকটস্থ ফ্লোর লেভেলে লিফট নিয়ে যাওয়ার জন্য অটোমেটিক রেসকিউ ডিভাইস (এআরডি) স্থাপিত নেই।
৪. লিফটের মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে বিবেচিত কন্ট্রোল প্যানেল মাইক্রোপ্রসেসর ও বিভিন্ন সেমিকন্ডাকটর দিয়ে তৈরি, যা নির্ধারিত তাপমাত্রায় রেখে ব্যবহারে কন্ট্রোল রুমে এয়ার কুলার স্থাপন করা হয়ে থাকে। কন্ট্রোল রুমে এয়ারকুলার বিদ্যমান থাকলেও অকেজো অবস্থায় রয়েছে।
৫. লিফট সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যাক্তিদের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, লিফটটিতে অতিরিক্ত লোক উঠলেও ওভার লোড সেন্সর কাজ করেনি। বিদ্যুৎ সরবরাহ সিস্টেমে ভোল্টেজ ফ্লাকচুয়েট বা অন্য কোনও ত্রুটিজনিত কারণে নির্দিষ্ট লেভেলে থামার জন্য সুইচ বা কন্ট্রোলার যথাযথভাবে কাজ না করায় নির্ধারিত লেভেলে থামতে পারেনি।
৬. সংশ্লিষ্ট লিফট ম্যানুফ্যাকচারের নির্দেশনা অনুয়ায়ী যে ডিভাইসগুলো ও ফাংশনগুলো মাসিক ভিত্তিতে পরীক্ষা করা প্রয়োজন, সেসব পরীক্ষা যথাযথভাবে হওয়ার প্রমান পাওয়া যায়নি।
৭. সার্ভিসিং ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের ওপর একক নির্ভরতা এবং কাজের সময়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের দায়িত্বশীলদের উপস্থিতি থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
৮. সাইটে অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স ম্যানুয়াল, অভিযোগ রেজিষ্টার, সার্ভিসিং, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ হিস্টরিবুক ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হযনি।
৯. লিফট অপারেটরের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকা সত্ত্বেও এমন অপারেটর নিয়োগ করা হয়েছে। এমনকি নিয়োগের পরও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়নি।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে আলোচনা সভায় যোগদান শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন হাসপাতালের ৯ থেকে ১০ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১০ম তলা থেকে নিচতলায় নামার জন্য লিফটে ওঠেন। লিফটটি চলতে শুরু করে দ্বিতীয় তলার কাছাকাছি এলে তারা একটি শব্দ শুনতে পান। এরপর লিফটটি থামার সময়ে আরও একটি শব্দ শুনতে পান।
নিচে লিফটটি থামার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে দরজা খোলেনি। পরে দায়িত্বরত লিফট অপারেটর পাশের লিফটের দায়িত্বে নিয়োজিত অপারেটরের সহায়তায় ৭ থেকে ৮ মিনিট পর দরজা খোলার ব্যবস্থা করেন। দরজা খোলার পর দেখা যায়, লিফটটি নির্ধারিত নিচতলার মেঝের সমতলে না থেমে মেঝে থেকে অনেকটা নিচে থেমেছে। এ পরিস্থিতিতে লিফট অপারেটরের নির্ধারিত টুলের (বসার জন্য অস্থায়ী ব্যবস্থা) সহায়তায় মন্ত্রীসহ লিফটে অবস্থানরত অন্যান্য কর্মকর্তাদের বের করে আনা হয়। এ ঘটনায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী উষ্মা ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
এবি/এইচএন