স্রষ্টা পৃথিবীর বংশগতি রক্ষার জন্য নারী ও পুরুষ প্রজাতির সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে বা পৌরাণিক কাহিনীতে অনেক বিখ্যাত নারী পুরুষের দেখা পাওয়া যায়। তেমনি এক নারী হলেন ‘হেলেন’ যার কারণে ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছিল। ট্রয় থেকে ট্রোজান মানে ‘প্রাচীন ট্রয় নগরবাসী।’ ট্রোজান হর্স (কাঠের ঘোড়া) প্রত্যয়টিও এসেছে এখান থেকেই। গ্রিক পুরাণে, প্রাচীন এশিয়া মাইনরের উত্তরে (বর্তমানে তুরস্কের আনাতোলিয়া রাজ্য) ছিল ট্রয় নামক এক নগরী।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
অ্যাকিলিসের বাবা মিরমিডোন্স রাজ্যের রাজা পিলিয়াস এবং গ্রিক দেবী থেটিসের বিবাহ অনুষ্ঠানে সকল দেবতাকে নিমন্ত্রণ করা হলেও ‘ইরিস’- দ্বন্দ্বের দেবীকে নিমন্ত্রণ করা হয় না। ইরিস তবুও অনুষ্ঠানে আসেন। তিনি একটি সোনালি আপেল (অ্যাপল অব ডিসকোর্ড) সঙ্গে আনেন, যাতে লেখা ছিল ‘সবথেকে সুন্দরীর জন্য’। তিন দেবী হেরা, এথিনা এবং এফ্রোদাইতি আপেলটি দাবী করেন এবং জিউসকে বিচারক হওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু জিউস অসম্মতি জানান এবং ট্রয়ের সুদর্শন রাজকুমার প্যারিসকে এ দায়িত্ব দেন। এফ্রোদাইতি প্যারিসকে পৃথিবীর সুন্দরীতম রমণী দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় প্যারিস এফ্রোদাইতিকে বিজয়ী ঘোষণা করেন । সবচেয়ে সুন্দরী রমণী ছিলেন অ্যাগামেমননের ভাই স্পার্টার রাজা মেনালাউসের স্ত্রী হেলেন।
এই ঐতিহাসিক ট্রয় নগরীর রাজা প্রিয়াম এবং রানি হেকবার ছেলে ছিল প্যারিস। প্যারিস বাণিজ্যিক কাজে স্পার্টা ভ্রমণে যান এবং সেখান থেকে হেলেনের সঙ্গে পালিয়ে (এফ্রোদাইতির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী) ট্রয়ে ফিরে আসেন ৷ মেনালাউস তার স্ত্রী এবং গ্রিকদের সম্মান ফিরিয়ে আনতে তার ভাই মাইসিনির অ্যাগামেমননের সাহায্য প্রার্থনা করেন। অ্যাগামেমনন সহজে রাজী হয়ে যান, কেননা এর মাধ্যমে ট্রয়কে গ্রিক সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে জয় করার সম্ভাবনা ছিল।
অ্যাগামেমনন অন্যান্য গ্রিক রাজাদের একত্রিত করে প্রায় এক হাজার জাহাজ নিয়ে ট্রয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তাদের যাত্রাপথে বাধা দেন দেবতা আর্টেমিস। সমুদ্রের বাতাস থেমে যায় আর্টেমিসের অভিশাপে। দেবতাকে খুশি করতে অ্যাগামেমনন তার নিজ কন্যা ইফিজিনিয়াকে হত্যা করেন উৎসর্গ হিসেবে। আর্টেমিস অভিশাপ তুলে নেওয়ায় গ্রিক সৈন্যবাহিনী অ্যাগামেমননের নেতৃত্বে ট্রয়ে পৌঁছায়।
কিন্তু দীর্ঘ দশ বছরে তারা ট্রয়ের দেয়াল ভেদ করতে পারেনি। যুদ্ধের শেষ বছরে অ্যাগামেমনন এবং তৎকালীন শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা অ্যাকিলিসের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর ফলে অ্যাকিলিস যুদ্ধে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। এ সময় প্যাট্রোক্লাস অ্যাকিলিসের বর্ম পরে যুদ্ধে যান এবং হেক্টরের (ট্রোজান সেনাপতি) হাতে নিহত হন। প্যাট্রোক্লাস অ্যাকিলিসের নিকট গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে অ্যাকিলিস হেক্টরের সাথে যুদ্ধের আহ্বান জানান এবং পরাজিত করেন। অ্যাকিলিস হেক্টরের মৃত দেহ টেনে তাদের শিবিরে নিয়ে আসেন। তখন ট্রয়ের রাজা এবং হেক্টরের পিতা প্রিয়াম রাতের অন্ধকারে অ্যাকিলিসের সাথে একা সাক্ষাৎ করেন এবং তার সন্তানের দেহ ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানান। অ্যাকিলিস রাজি হন এবং ১১ দিনের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন।
এই সময়ে ওডেসিয়াস একটি কাঠের ঘোড়া তৈরির বুদ্ধি বের করেন। একটি বিরাট কাঠের ঘোড়া, যার ভেতরে গ্রিক সৈন্যরা অবস্থান নেন। ঘোড়াটি তীরে রেখে গ্রিকরা ফিরে যায়। ট্রোজানরা ভাবে ঘোড়াটি তাদের জন্য উপহার হিসেবে রেখে গিয়েছে গ্রিকরা। ট্রোজান সৈন্যরা তাদের দেয়াল ভেঙ্গে ঘোড়াটিকে শহরে নিয়ে যায়। রাতে যখন তারা তাদের বিজয় উদযাপনে মত্ত থাকে তখন ঘোড়ার ভেতর থেকে গ্রিক সৈন্যরা বের হয়ে আসে এবং শহরের ফটক খুলে দেয় অন্যান্য গ্রিক সৈন্যদের প্রবেশের জন্য, যারা আসলে ফিরে না গিয়ে সমুদ্রে অপেক্ষারত ছিল। এভাবে তারা জয় করে ট্রয় নগরী। প্রিয়ামকে হত্যা করা হয়। হেক্টরের শিশু সন্তানকে ট্রয়ের দেয়াল থেকে নিচে ছুড়ে ফেলা হয়। অ্যাকিলিস নিহত হন প্যারিসের ছোড়া তীরে। দীর্ঘ দশ বছরের ট্রোজান যুদ্ধে ট্রয় নগরী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং মেনালাউস হেলেনকে নিয়ে গ্রীসে ফেরেন।
১৯৯৮ সালে ট্রয় নামক এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় স্থান পায়। ট্রয় নগরীর বাস্তবতার পক্ষ-বিপক্ষ মতামত থাকলেও এখান থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। ছোট্ট একটা দ্বন্দ্ব কীভাবে একটা নগরীর ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। এরকম ছোট ছোট কিছু ব্যক্তিগত (বিয়ের দাওয়াত না পাওয়া) বিষয়কে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে আমাদের চারপাশটা আরও বেশি বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক