সাজু আহমেদ: আজ বিশ্বের তরুণ-তরুণীদের জন্য বিশেষ আনন্দের দিন। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। বলা হয় ওয়ার্ল্ড ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবস। কাকতালীয়ভাবে ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন পহেলা ফাল্গুন। এছাড়া সনাতন ধর্মাবললম্বীদের অন্যতম পবিত্র দিন স্বরস্বতী পূজা। একই দিনে একাধিক বিশেষ বিষয় পড়ে যাওয়ায় বাঙ্গালীদের কাছে আজ দিবসটির বিশেষ গুরুত্ব বহণ করছে। তবে সবচেয়ে এগিয়ে ভালোবাসার বিষয়টি।
রাজধানীবাসির জন্য দিবসটি আরও বেশী উচ্ছ্বাসের। যার প্রভাব আজ দেখা যাবে চলমান বই মেলায়, বাণিজ্যমেলায়। আর রাজধানীর বিভিন্ন পার্কে রেস্তোরাঁয় তো বটেই। তরুণ তরুণী তো বটেই প্রায় সব বয়সেরই মানুষের ভালবাসা আস্থা এবং বিশ্বাসকে ভাগাভাগি করার জন্য দিবসটি একটি উদাহরণ হিসেবে মনে করে অনেকেই। বলা হয়ে থাকে যে এই দিবসে বাঙালি মনের ভালোবাসাও আজ হয় পবিত্র।
এদিনে নানা ফুল উপহারে রাঙা আর বাসন্তী মোহে মুগ্ধ সবাই। ভালোবাসা দিবসে যুগলদের মনের এই উচ্ছ্বাসকে বাড়িয়ে দেবে কয়েকগুণ। শুধু তরুণ-তরুণী নয়, নানা বয়সের মানুষই ভালোবাসার এই দিনে একসঙ্গে সময় কাটাবেন। দিনটি পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হলেও ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবসে বাঙালি মনের ভালোবাসাও যেন পায় নতুন রূপ। আজকের এ ভালোবাসা শুধুই প্রেমিক আর প্রেমিকার জন্য নয়। মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোন, প্রিয় সন্তান এমনকি বন্ধুর জন্যও ভালোবাসার জয়গানে আপ্লুত হতে পারে সবাই। চলবে উপহার দেয়া- নেয়া। রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে সারা দিন ঘোরাঘুরি করে কাটাবে ভালোবাসার মানুষগুলো। তাদের পরনে লাল, নীল, সাদা, বেগুনি, গোলাপি বিভিন্ন রঙের পোশাক আর সাজসজ্জায় ভালোবাসার দিনটি যেন বর্ণিল রঙে রঙিন হয়ে উঠবে।
দিবসটি উপলক্ষে প্রতি বছর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে কনসার্টেরও আয়োজন করা হয়। অনেকের মতে, ফেব্রুয়ারির এ সময়ে পাখিরা তাদের জুটি খুঁজে বাসা বাঁধে। নিরাভরণ বৃক্ষে কচি কিশলয় জেগে ওঠে। তীব্র সৌরভ ছড়িয়ে ফুল সৌন্দর্যবিভায়। পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়। এ দিনে চকোলেট, পারফিউম, গ্রিটিংস কার্ড, ই-মেইল, মুঠোফোনের এসএমএস-এমএমএসে প্রেমবার্তা, হীরার আংটি, প্রিয় পোশাক, জড়াজড়ি করা খেলনা মার্জার অথবা বই ইত্যাদি শৌখিন উপঢৌকন প্রিয়জনকে উপহার দেয়া হয়। নীল খামে হালকা লিপস্টিকের দাগ, একটা গোলাপ ফুল, চকোলেট, ক্যান্ডি, ছোট্ট চিরকুট আর তাতে দুদছত্র গদ্য অথবা পদ্য হয়ে উঠতে পারে উপহারের অনুষঙ্গ।
ইতিহাসবিদদের মতে, দুটি প্রাচীন রোমান প্রথা থেকে এ উৎসবের সূত্রপাত। এক খ্রিস্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক ফাদার সেন্ট ভ্যালেনটাইনের নামানুসারে দিনটির নাম ‘ভ্যালেনটাইনস ডে’ করা হয়। ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি খ্রিস্টানবিরোধী রোমান সম্রাট গথিকাস আহত সেনাদের চিকিৎসার অপরাধে সেন্ট ভ্যালেনটাইনকে মৃত্যুদন্ড দেন। মৃত্যুর আগে ফাদার ভ্যালেনটাইন তার আদরের একমাত্র মেয়েকে একটি ছোট্ট চিঠি লেখেন, যেখানে তিনি নাম সই করেছিলেন ‘ফ্রম ইওর ভ্যালেনটাইন’।
সেন্ট ভ্যালেনটাইনের মেয়ে এবং তার প্রেমিক মিলে পরের বছর থেকে বাবার মৃত্যুর দিনটিকে ভ্যালেনটাইনস ডে হিসেবে পালন করা শুরু করেন। যুদ্ধে আহত মানুষকে সেবার অপরাধে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত সেন্ট ভ্যালেনটাইনকে ভালোবেসে দিনটি বিশেষভাবে পালন করার রীতি ক্রমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ভ্যালেনটাইনস ডে সার্বজনীন হয়ে ওঠে আরও পরে প্রায় ৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। দিনটি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাওয়ার পেছনে রয়েছে আরও একটি কারণ। সেন্ট ভ্যালেনটাইনের মৃত্যুর আগে প্রতি বছর রোমানরা ১৪ ফেব্রুয়ারি পালন করত ‘জুনো’ উৎসব।
রোমান পুরানের বিয়ে ও সন্তানের দেবী জুনোর নামানুসারে এর নামকরণ। এ দিন অবিবাহিত তরুণরা কাগজে নাম লিখে লটারির মাধ্যমে তার নাচের সঙ্গীকে বেছে নিত। ৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রোমানরা যখন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীতে পরিণত হয় তখন ‘জুনো’ উৎসব আর সেন্ট ভ্যালেনটাইনের আত্মত্যাগের দিনটিকে একই সূত্রে গেঁথে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘ভ্যালেনটাইনস ডে’ হিসেবে উদযাপন শুরু হয়। কালক্রমে এটি সমগ্র ইউরোপ এবং ইউরোপ থেকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
বলে রাখা ভালো ‘ভালোবাসা’ শব্দটা নেহাত বড় না হলেও এর পরিধি বিশাল। ভালোবাসা হলো একটি শব্দ, একটি অনুভূতি। সমাজ, সংসারের শুরু থেকেই পারস্পরিক ভালোবাসা, শ্রদ্ধার মধ্যে দিয়েই মানুষ একে অপরের সাথে মিলেমিশে চলে আসছে। পৃথিবীর সবকিছু নির্দিষ্ট করে সংজ্ঞায়িত করা গেলেও ভালোবাসার নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা নেই। নেই বাঁধা ধরা নিয়মনীতি, নেই কোন দিনক্ষণ। কিন্তু বর্তমানে অপসংস্কৃতির কালো থাবার কারণে দেশে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন দিবস বর্তমানে ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’ নামে ব্যাপক উদ্দীপনার সাথে পালিত হচ্ছে। মূলত দিবসটি ছিল প্রাচীন ইউরোপীয় গ্রীক-রোমান পৌত্তলিকদের একটি ধর্মীয় দিবস। ভারতীয় আর্যদের মতই প্রাচীন রোমান পৌত্তলিকরা মধ্য ফেব্রুয়ারি বা ১লা ফাল্গুন ভূমি ও নারী উর্বরতা, নারীদের বিবাহ ও সন্তান কামনায় প্রাচীন দেবদেবীদের বর লাভ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বিভিন্ন নগ্ন ও অশ্লীল উৎসব পালন করত; যা লুপারকালিয়া উৎসব নামে প্রচলিত ছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে আজ ভালোবাসা দিবস অশ্লীলতায় রূপ নিয়েছে। বরং এ সময়ের ভালোবাসা ভালোলাগাগুলোয় স্থায়িত্ব কমে বেড়েছে দিবসের নামে নোংরামি। পার্ক জুড়ে দেখা যায় প্রেমিক প্রেমিকাদের ঢল। এ দিবসে যুবক-যুবতীদের আড্ডা, গল্পগুজব, উল্লাস করা বা অনুরূপ যেকোনো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহপূর্ব ভালোবাসার উসকানি দেওয়া নৈতিক অবক্ষয়য়ের মূল কারণ।
পশ্চিমা বিশ্বের অপসংস্কৃতি আমাদের করছে বিপর্যস্ত। যুবসমাজ এর বেড়াজালে পা দিচ্ছে, যা নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটিয়ে প্রতি মুহূর্তে নব নব বিপদ সঙ্কেতের আভাস দিচ্ছে। তাই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থে ভালোবাসা দিবসের নামে এমনসব গর্হিত কাজকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে প্রতিরোধ করতে হবে। ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।
মূলত তৃতীয় শতাব্দীর ২৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস বিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, প্রেম-ভালোবাসা বাদ দিয়ে দেশরক্ষার নির্দেশ দেন। এ সময় সম্রাটের নির্দেশের বিরোধিতা করেছিল এক যুবক, যার নাম ভ্যালেন্টাইন। সে চেয়েছিল প্রেম-বিয়ে এসব চালু রাখতে। এই বিদ্রোহের শাস্তিস্বরূপ তার আঙুল কেটে ফেলা হলো এবং তাকে কারাবন্দি করা হলো।
এক কারারক্ষীর মেয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং প্রতিনিয়ত মেয়েটি তার কাছে আসতে থাকে। তাদের এ সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে তাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয় এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। ওই ঘটনাকে স্মরণ করে পোপ জেলসিয়ান দিবসটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য ১৪ ফেব্রুয়ারিকে আধুনিক নামে সাজিয়ে ভালোবাসা দিবস বলে ঘোষণা দেন।
এবি/এইচএন