সংগৃহীত
পরিবেশ

টাঙ্গুয়ার হাওরের চিরচেনা দৃশ্য বদলে যাচ্ছে

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

বিশ্ব ঐতিহ্য টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রায় সব জায়গা শীতকালে মুখরিত থাকত অতিথি পাখির কিচিরমিচিরে। শীতকালে হাওরটি হয়ে উঠত পাখির মেলার স্থল। হাওরের জলে পাখিদের অবাধ বিচরণ মুগ্ধ হয়ে দেখতেন পর্যটকরা।

কিন্তু হাওরের চিরচেনা সেই দৃশ্য বদলে যাচ্ছে। এখন আর চোখে পড়ে না তা। ক্রমেই কমছে অতিথি পাখির মিছিল। ফলে পাখিপ্রেমী পর্যটকরাও ফিরছেন হতাশ হয়ে।

স্থানীয়রা জানান, ফাঁদ পেতে পাখি শিকার, পর্যটকদের উৎপাত, অবাধে সংরক্ষিত এলাকায় শ্যালো মেশিন চালানো, বনায়ন কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে টাঙ্গুয়ার হাওরে অতিথি পাখি কমে আসছে।

বরাবরের মতো পাখি গণনা করতে বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাব ও দাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার-আইইউসিএনের একটি দল আসার কথা রয়েছে হাওর এলাকায়। তারা ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে সপ্তাহব্যাপী টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখি গণনা করবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ের গ্রাম মুসিলমপুরের কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, কয়েক বছর আগেও প্রচুর পাখি আসত। পাখির শব্দে এই সময় রাতে ঘুমাতে পারতাম না। কিন্তু এখন আগের চেয়ে অর্ধেক পাখিও দেখি না। পাখির আনাগোনা কমে গেছে।

পর্যটকদের উৎপাত, বনজঙ্গল কমে যাওয়া এবং শিকারীদের উৎপাতের কারণে এ বছর পাখি কম আসছে বলে মনে করেন তিনি।

আব্দুর রহমান বলেন, হাওর পাড়ের কিছু গ্রামে এক শ্রেণির পেশাদার পাখি শিকারি রয়েছেন। তারা বিভিন্ন ফাঁদযন্ত্র দিয়ে পাখি শিকার করেন। হাওরের কান্দাশ্রেণির জমিতে শিকারীরা রাতে পাখি আশ্রয় নেওয়ার আগে কারেন্টের জাল ও সুতা পেঁচিয়ে ফাঁদ পেতে রাখেন। বিভিন্ন সময়ে শহর থেকেও পাইকাররা এসে খাঁচা ভরে পাখি কিনে নিয়ে যান। স্থানীয় খাবার হোটেলগুলোতেও পাখির মাংসের বেশ কদর রয়েছে।

মেঘালয়ের পাদদেশে তাহিরপুর, মধ্যনগর উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওর ‘রামসার সাইট’ হিসেবে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। শুধু অতিথি পাখির জন্য নয়, বর্ষাকালেও দেশের পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য এখন সুনামগঞ্জের এ হাওর। দুই দশক আগে টাঙ্গুয়ার হাওর ঘিরে পর্যটন শুরু হলেও তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে কয়েক বছর ধরে। বিস্তৃত জলরাশির এই হাওরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য জলে ভাসানো হয়েছে শতাধিক দৃষ্টিনন্দন হাউস বোট।

প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে ইজারা প্রথা বাতিলের পর ২০০৩ সালের ১০ নভেম্বর হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন। এরপর প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার-আইইউসিএন ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে থেকে হাওরে ‘সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ শুরু করে। ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, আইইউসিএন চলে যাওবার পর টাঙ্গুয়ার হাওরে এখন আর কোনো প্রকল্প নেই। তবে আমাদের নজরদারিতে আছে। সংকটাপন্ন এই এলাকার পরিবেশের ওপর আঘাত আসলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি। তবে সার্বক্ষণিক নজরদারি আমরা করতে পারি না। যখনই পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে খবর পাই, তখনই আমরা ব্যবস্থা নেই।

টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত ডিসেম্বরের শেষ দিকেই হাওরে অতিথি পাখি আসতে শুরু করে। বিশাল জলাধারে স্বচ্ছ জলে মাথা ডুবিয়ে ডানা ঝাপটিয়ে বিরলপ্রায় পাখি কোড়া, রামকোড়া, হটা, রামহটা, ল্যাঞ্জা হাঁস, নীলমাথা হাঁস, টিকিহাঁস, বালিহাঁস, সরালি, রাজসরালি, পাতি মাছরাঙ্গা, পাকড়া মাছরাঙ্গা, চখাচখি রামদোলা কিচিরমিচির করত। একটু শব্দ পেলেই উড়াল দিয়ে যেত দূরে। কিন্তু এখন এমন দৃশ্য প্রায় হারাতে বসেছে।

জানুয়ারি শেষ হতে চললেও এবার পাখি তেমন আসেনি। স্থানীয় কিছু লোকজন ক্রমশ জ্বালানি সংগ্রহের জন্য বৃক্ষ নিধন, সংরক্ষিত এলাকায় শ্যালো ইঞ্জিন চালিত নৌকায় সাউন্ড সিস্টেম বাজিয়ে পর্যটকদের অবাধ ঘোরাঘুরি, চোরাই শিকারীদের তৎপরতা এবং বনাঞ্চল কমে যাওয়ার কারণে পাখির আগমনও কমছে বলে মনে করছেন তারা।

টাঙ্গুয়ার হাওরে আগের তুলনায় পাখি কমেছে বলে পরিবেশকর্মী রিপচান হাবিবও মনে করেন। তিনি বলেন, পাখির বিচরণ তথা প্রকৃতির সুরক্ষায় বনবিভাগ জলবায়ু তহবিলের বরাদ্দে গাছ লাগানোর কথা থাকলেও প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা গাছ তুলে অন্যত্র লাগানোয় দুই বছর আগে সব গাছ মরে গেছে। এই প্রকল্পের পুরো বরাদ্দই নয়-ছয় হয়েছে। এখন কিছু চোরাই শিকারীও ফাঁদ পেতে পাখি ধরছেন।

হাওর এলাকার বাসিন্দা পরিবেশকর্মী আহমদ কবীর বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওর পাখি, মাছ, গাছের জন্য বিখ্যাত ছিল। কিন্তু এখন প্রতিনিয়ত এগুলো কমছে। আগের মতো পাখি দেখা যায় না। কয়েক বছর আগে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে বিপুল পাখির আগমন ঘটত। কিন্তু এবার সেই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, দেশের ৪২১টি হাওরের মধ্যে সর্বাধিক ১৩৭টি হাওরের অবস্থান সুনামগঞ্জে। টাঙ্গুয়া সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের মাধ্যমে পাখির নিরাপদ অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তুলতে লেচুয়ামারা ও বেরবেরিয়া বিলের কান্দা জঙ্গলে প্রায় ৭০ হাজার হিজল করচ ও বরুণ গাছ লাগানোর কথা বলা হলেও সেগুলোর সিকিভাগও বাঁচেনি। এ দুটি বিল এখন পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে স্বীকৃত ও সংরক্ষিত। এ ছাড়া প্রকৃতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে টাঙ্গুয়ার হাওরের ইকইদাইড়সহ কিছু এলাকায় জলবায়ু তহবিলের টাকায় বৃক্ষ লাগানোর কথা থাকলেও এই প্রকল্পের পুরো বরাদ্দই নয়-ছয় করেছে বনবিভাগ। যার ফলে পাখির বাস্তুসংস্থানের সমস্যা রয়েছে।

পাখি বিশেষজ্ঞরা টাঙ্গুয়ার হাওরে এক দশক আগেও বিরল রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড (লাল ঝুটি), পিন টেনল (ল্যাঞ্জা হাস), সভেলার (খুন্তে হাঁস), মালার্ড (নীলমাথা হাঁস), পিয়াং হাঁস (গাডওয়াল), ঠাফটেউ (টিকিহাঁস), কঁনপিগমি (ধলা বালিহাঁস). বেগুনি কালেম, ডাহুক, পান মুরগি, সরালি, রাজসরালি, পাতিমাছরাঙা, পাকড়া মাছরাঙা ও চখাচখির পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। পৃথিবীর বিরলপ্রায় প্যালসিস ঈগলের দেখাও মিলেছিল টাঙ্গুয়ার হাওরে। কিন্তু পাখি কমতে থাকায় প্যালসিস ঈগলও দেখা যাচ্ছে না।

পাখিগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম থাকলেও টাঙ্গুয়ার হাওরপাগের মানুষজন এসব পাখিকে ফরালি, অইক্কা, মৌলভী, বালিহাঁস, সিংলাই, ভোদর, পানকৌড়ি, কোড়াপাখি, পানি খাউরি, লেঞ্জাসহ নানা নামেই ডাকেন। এই প্রজাতির কিছু পাখি এখনও হাওরে দেখা যাচ্ছে।

টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রতিবেশ প্রকল্পে যুক্ত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সিএনআরএসের সাইট অফিসার শাহ কামাল বলেন, আমরা কিছু দিন ধরে হাওরের প্রতিবেশ সুরক্ষায় বাংলাদেশের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা-ইসিএ ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয়দের সঙ্গে কাজ করছি। কোর জোন ও বাফার জোনের প্রতিবেশ সুরক্ষায় সচেতনতা অভিযান চালাচ্ছি। তবে এর মধ্যেই আমরা জানতে পেরেছি কিছু লোক ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করছে। স্থানীয়রা আমাদের বলছেন, কয়েক বছর ধরে পাখি কমছে। তবে ইসিএ রোল বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসনকে সচেতন না হলে সুফল মিলবে না।

টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখি গণনায় নেতৃত্ব দানকারী পাখি বিশারদ ও বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের সহসভাপতি সীমান্ত দীপু বলেন, ১৫ জানুয়ারির পর থেকে হাওরটিতে পাখি আসা শুরু করেছে। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে সপ্তাহব্যাপী পাখি গণণা শুরু হবে। গণনা শেষে বলা যাবে, এবার কী পরিমাণ পাখি এসেছে হাওরটিতে। তবে পরিযায়ী পাখিকে বিরক্ত না করতে প্রশাসনকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

হাওরে পাখি শিকার প্রসঙ্গে তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল হাসেম বলেন, আমরা সম্প্রতি চোরাই শিকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছি। কেউ যাতে অতিথি পাখিদের বিরক্ত করতে না পারে, সেজন্য দৃষ্টি রেখেছি।

তিনি বলছেন, পাখির অভয়াশ্রম এলাকা বা সংরক্ষিত এলাকায় কেউ মাইক বাজালে বা শ্যালো মেশিন নিয়ে ঘোরাঘুরি করলে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা বাধা দেন। আমরাও হাওরে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি হয়, এমন আচরণ না করতে সবাইকে সাবধান করি।

আমারবাঙলা/এমআরইউ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

বিমানে তল্লাশি করে বোমা পাওয়া যায়নি: কর্তৃপক্ষ

ইতালির রোম থেকে ঢাকাগামী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে বোমা হামলার...

মাদকবিরোধী অভিযানে ২০০ পিস টাপেন্টাডলসহ গ্রেফতার ১

রাজবাড়ী জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) কর্তৃক পরিচালিত...

জয়শঙ্কর-রুবিও বৈঠক, বাংলাদেশ নিয়েও আলোচনা 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের...

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের দায়িত্ব ছাড়লেন সারজিস

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম জানিয়েছ...

মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা ১৮ হাজার কর্মীকে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু মার্চে

মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা ১৮ হাজার কর্মীকে আগামী মার্চে দেশটিতে পাঠানোর প্রক্রি...

হলিউড হয়ে যেতেও পারে কোনো দিন: জায়েদ খান

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভার...

রাজবাড়ীতে অভিযানে সাজাপ্রাপ্ত ৫ আসামি গ্রেপ্তার

রাজবাড়ী সদর থানা পুলিশের বিশেষ অভিযানে সাজাপ্রাপ্ত ৫ জন ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিকে...

বড়লেখায় যুবদল নেতা নোমান হত্যা মামলার ২ আসামি গ্রেপ্তার 

মৌলভীবাজারের বড়লেখায় যুবদল নেতা নোমান হোসেন (৩৪) হত্যা মামলার দুই আসামিকে গ্র...

লেবু বাগানে মিললো ব্যবসায়ীর গলাকাটা লাশ

টাঙ্গাইলের সখীপুরে আবদুস সালাম (৫০) নামে এক ব্যবসায়ীকে জবাই করে হত্যা করেছে দ...

আত্মগোপনে থাকা মানিকগঞ্জের যুবলীগ নেতা ঢাকায় গ্রেফতার

মানিকগঞ্জ জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ও পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র একাধিক মামলার আস...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা