অস্কারজয়ী অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্নের জীবনের একটি অধ্যায়ের কথা অনেকেরই হয়তো অজানা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। নাৎসি দখলদারির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ডাচ প্রতিরোধ বাহিনীর জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে ব্যালে মঞ্চস্থ করতেন এই অভিনেত্রী। তখন তিনি কেবল কিশোরী।
অস্কারের জন্য পাঁচবার মনোনীত হয়েছিলেন হেপবার্ন। রোমান হলিডে সিনেমায় অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রী হিসেবে অস্কার জিতেছিলেন ১৯৫৩ সালে। ১৯৫০ ও ৬০–এর দশকে চলচ্চিত্র ও ফ্যাশনজগতের আইকন হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
বিবিসি রেডিও ৪-এর ‘হিস্ট্রিজ ইয়ংগেস্ট হিরোজ’ শীর্ষক পডকাস্টে নিকোলা কফলান ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এমন সব তরুণের গল্প বলছেন, যারা বিশ্বকে পরিবর্তন করেছে। বিদ্রোহ, ঝুঁকি ও তরুণ শক্তির মিশেলের অসাধারণ সব গল্পের তালিকায় অড্রে হেপবার্নও স্থান পেয়েছেন।
অড্রে হেপবার্ন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার জীবন সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায় রবার্ট ম্যাটজেনের লেখা ডাচ গার্ল বই থেকে। হিস্ট্রিজ ইয়ংগেস্ট হিরোজ পডকাস্টের জন্য এক সাক্ষাৎকারে ওই লেখককে অড্রে হেপবার্নের কনিষ্ঠ পুত্র লুকা ডটি বলেছিলেন, ‘উনি খুব মিশুক ছিলেন। হাসতেন, খেলতেন, অভিনয় করতেন। আমার নানা তাকে মজা করে মাংকি পাজল বলে ডাকতেন।’
নীতিগতভাবে নাৎসিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন অড্রে হেপবার্নের চাচা কাউন্ট অটো ভ্যান লিমবার্গ স্টিরাম। ১৯৪২ সালে একটা প্রতিরোধকারী গোষ্ঠী রটারডামের কাছে একটি জার্মান ট্রেন বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এ ঘটনায় জড়িত না থাকার পরও গ্রেপ্তার করা হয় কাউন্ট লিমবার্গ স্টিরামকে। নাৎসি এজেন্টরা তাকেসহ আরো চারজনকে ধরে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে গুলি করে এবং দেহগুলো মাটি চাপা দিয়ে আসে। চাচাকে বাবার মতোই ভালোবাসতেন অড্রে হেপবার্ন। এই হত্যাকাণ্ড তার মনের গভীরে দাগ ফেলে।
অড্রে হেপবার্নের বয়স যখন ১৫ বছর, তখন তাকে একটা শর্ত দেওয়া হয়। নাৎসি শিল্পীদের ইউনিয়ন ‘কাল্টরকামার’-এ যোগ দিতে হবে অথবা প্রকাশ্যে নাচ করা ছেড়ে দিতে বলা হয় তাকে। খুব পছন্দের বিষয় হলেও প্রকাশ্যে নাচের পারফরম্যান্স ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তবে নাচ তিনি আসলে ছাড়েননি। করতেন লুকিয়ে। লুকিয়ে আয়োজন করা ব্যালে অনুষ্ঠানে মৃদু সুরে পিয়ানো বাজানো হতো। কেউ হাততালি দিতে পারতেন না। সবশেষে অনুষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করা অর্থ ব্যবহার করা হতো নাৎসিদের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা প্রতিরোধ বাহিনীর কাজকর্মের জন্য।
১৯৪৪ সালের বসন্তে হেনড্রিক ভিসার হুফ্ট নামের এক চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে কাজ করা শুরু করেন অড্রে হেপবার্ন, যিনি প্রতিরোধযোদ্ধা দলের সদস্য ছিলেন। ঘটনাটি ১৯৪৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের। তখন গির্জায় ছিলেন হেপবার্ন। সেই সময় হঠাৎই ইঞ্জিনের তীব্র আওয়াজ শোনা যায়। ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে ‘অপারেশন মার্কেট গার্ডেন’, যা ছিল রাইন নদীর ওপর বিস্তৃত নয়টি সেতু দখল করার জন্য মিত্র বাহিনীর একটি পরিকল্পনা। সেখানে জার্মানির উদ্দেশে রওনা হওয়া মিত্রবাহিনীর বৈমানিকেরা নেদারল্যান্ডসে জরুরি অবতরণ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই সময় অড্রে হেপবার্নকে দিয়ে তাদের কাছে খবর পাঠাতেন চিকিৎসক হুফ্ট।
এক ব্রিটিশ প্যারাট্রুপারের সঙ্গে দেখা করার জন্য অড্রে হেপবার্নকে জঙ্গলে পাঠিয়েছিলেন ডাক্তার হুফ্ট। অড্রে তার মোজার মধ্যে লুকিয়ে নেন সাংকেতিক বার্তা। বৈঠকের পর জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসার সময় তিনি লক্ষ করেন, তার দিকে ডাচ পুলিশ এগিয়ে আসছে। এটি দেখে হঠাৎ করে ঝুঁকে বুনো ফুল কুড়াতে শুরু করেন তিনি। তারপর মোহময়ী ভঙ্গিতে তা পুলিশ কর্মীদের দিকে এগিয়ে দেন। হেপবার্নকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে আর বিশেষ জিজ্ঞাসাবাদ করেনি তারা। এরপর থেকে নাৎসিদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ বাহিনীর জন্য প্রায়ই বার্তা বহন করতেন তিনি।
ক্যারিয়ারজুড়ে অভিনয় ছাড়াও জনহিতকর কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন অড্রে হেপবার্ন। তিনি ইউনিসেফের গুড উইল অ্যাম্বাসেডর ছিলেন। তার মৃত্যু হয় ১৯৯৩ সালে।
আমারবাঙলা/এমআরইউ