মার্কিন পপ তারকা টেলর সুইফটের ২১ মাসব্যাপী ‘ইরাস ট্যুর’ শেষ হয়েছে ৮ ডিসেম্বর। তার এই ট্যুর বা কনসার্ট ২১ মাসে বৈশ্বিক পপ সংস্কৃতি ও বিনোদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঘটনা। এটিকে বিশ্বসংগীতের ইতিহাসে বৃহত্তম কনসার্ট বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। টেলরের এই ট্যুর বা কনসার্ট যেখানে হয়েছে, সেখানকার স্থানীয় অর্থনীতিও চাঙা হয়ে উঠেছে।
সুইফটের এই ট্যুরের সর্বশেষ তথা ১৪৯তম কনসার্ট ৮ ডিসেম্বর ভ্যাঙ্কুভারের ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়। এটিসহ সব কনসার্টে মোট ২০৭ কোটি ৭৬ লাখ ১৮ হাজার ৭২৫ মার্কিন ডলারের টিকিট বিক্রি হয়েছে। ইতিহাসে এর আগে যে ট্যুর কনসার্টে সবচেয়ে বেশি আয় হয়েছিল, সেটির চেয়ে সুইফটের ইরাস ট্যুরে অন্তত দ্বিগুণ আয় হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক কনসার্ট ব্যবসার নতুন মানদণ্ড নির্ধারিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। খবর নিউইয়র্ক টাইমসের
টেলর সুইফটের সংগীত প্রযোজনা কোম্পানি টেলর সুইফট ট্যুরিংয়ের সূত্রে মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, এই ট্যুর কনসার্টের বিক্রীত টিকিটের অর্থ নিয়ে সন্দেহ ছিল। দুই বছর আগে থেকে এই কনসার্টের টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার সময় থেকে ট্যুর নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করেছিলেন।
সম্প্রতি আর যে ট্যুর কনসার্টের সঙ্গে টেলর সুইফটের ইরাস ট্যুরের তুলনা করা হয় তা হলো, কোল্ডপ্লের ট্যুর কনসার্ট। ওই ট্যুরের টিকিট বিক্রি করে কোল্ডপ্লে এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার আয় করে। দুই ট্যুরের কনসার্টের সংখ্যা ছিল প্রায় সমান, কিন্তু কোল্ডপ্লের তুলনায় টেলর সুইফট দ্বিগুণ অর্থ আয় করেন।
সুইফটের কোম্পানির তথ্যানুসারে, ইরাস ট্যুরের প্রতিটি কনসার্টের সব টিকিটই বিক্রি হয়েছে। তাদের তথ্যানুসারে, মোট এক কোটি ১৬ লাখ আট হাজার আট জন মানুষ সুইফটের কনসার্ট উপভোগ করেছেন। প্রতিটি টিকিটের গড় দাম ছিল ২০৪ ডলার। অথচ ২০২৩ সালে বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি কনসার্টের টিকিটের গড় দাম ছিল ১৩১ ডলার।
টেলর সুইফটের সবচেয়ে বড় কনসার্ট হয় অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এই কনসার্টে উপস্থিত ছিলেন মোট ৯৬ হাজার ছয় জন দর্শক। এ ছাড়া লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে টেলর সুইফট আটটি কনসার্ট করেছেন। আটটি কনসার্টে মোট সাত লাখ ৫৩ হাজার ১১২ জন দর্শক উপস্থিত ছিলেন; যা প্রায় যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল প্রদেশের জনসংখ্যার সমান।
এ ধরনের কনসার্টে কেবল টিকিটই বিক্রি হয় না, তার সঙ্গে টি-শার্ট, টুপিসহ বিভিন্ন উপহারসামগ্রী বিক্রি হয়ে থাকে। এসব বিক্রির হিসাব টেলর সুইফটের কোম্পানি আমলে নেয়নি। অথচ এসব পণ্যেরও চাহিদা এমন আকাশচুম্বী ছিল যে মানুষ কনসার্টের টিকিট না পেলেও যেন এসব পণ্য কিনতে পারেন, সে জন্য স্টেডিয়ামের বাইরে অনুষ্ঠানের এক দিন আগে বুথ স্থাপন করা হয়।
টিকিটের মূল্য হিসাব করা হয়েছে আনুষ্ঠানিক দর দিয়ে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যেসব টিকিট হাত বদল হয়েছে, সেগুলোর দাম যে কয়েক গুণ বেড়েছে, সেই হিসাব আমলে নেওয়া হয়নি। টিকিট বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান স্টাবহাবের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, তাদের কোম্পানির ২০ বছরের ইতিহাসে এটি ছিল সবচেয়ে বড় কনসার্ট ট্যুর। ২০২৩ সালে বিয়ন্সের কনসার্ট উপলক্ষে যত টিকিট তারা বিক্রি করেছে, ইরাস ট্যুরের টিকিট বিক্রি হয়েছে তার পাঁচ গুণ।
আরেক টিকিট বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ভিক্টরি লাইভের তথ্য হলো, যত টিকিট পুনর্বার বিক্রি হয়েছে, সেগুলোর গড় মূল্য ছিল দুই হাজার ৯৫২ ডলার। টিকিট পুনর্বিক্রয় থেকে কোনো আয় অবশ্য টেলর সুইফট পাননি।
এই ট্যুর কনসার্টের মধ্য দিয়ে সংগীতের জগতে নতুন স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছেন টেলর সুইফট। নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদে বলা হয়েছে, ১৯৬০-এর দশকে বিটলস যে উচ্চতায় উঠেছিল বা ১৯৮০-এর দশকে মাইকেল জ্যাকসন যেখানে পৌঁছেছিলেন, টেলর সুইফটও তার ইরাস ট্যুর করে সেই উচ্চতায় উঠে গেছেন। আর এর বদৌলতে তিনি সাংস্কৃতিক জগতের যুগসন্ধির প্রতীক হয়ে উঠেছেন। এখন সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগ। ইরাস ট্যুরে টেলর সুইফট যতবার মঞ্চে উঠেছেন, যেসব পোশাক পরেছেন, মঞ্চের বাইরে কী পোশাক পরেছেন, তার সবকিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভালোভাবে উঠে এসেছে। এমনকি মূল ধারার সংবাদমাধ্যমেও ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। এভাবে সেগুলোর রেকর্ড সংরক্ষিত হয়েছে।
এই সফলতার স্বীকৃতিও পেয়েছেন টেলর সুইফট। সম্প্রতি চলতি শতকের সেরা ২৫ পপশিল্পীর তালিকা প্রকাশ করেছে বিলবোর্ড সাময়িকী। এই তালিকার দুই নম্বরে উঠে এসেছেন সুইফট। শীর্ষে আছেন মার্কিন গায়িকা বিয়ন্সে।
ইরাস ট্যুরের শেষ কনসার্টে স্বাভাবিকভাবেই আবেগ ছুঁয়ে যায় টেলর সুইফটকে। পাঁচটি মহাদেশের ৫৩টি শহরে ১৪৯টি কনসার্ট—এমন একটি কনসার্ট ট্যুরের সমাপ্তিতে আবেগ ছুঁয়ে যাওয়ারই কথা। তিনি এই ট্যুরে ছুটে বেড়িয়েছেন টোকিও, প্যারিস থেকে বুয়েনস এইরেস। ২০২৩ সালের ১৭ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা থেকে শুরু হয়েছিল যে কনসার্ট, তার সফল সমাপ্তি ঘটে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে।
রেকর্ড পরিমাণ টিকিট বিক্রি, কনসার্টে কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী প্রিন্স উইলিয়ামের মতো ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতি এবং বিশ্বখ্যাত অভিনেতা টম ক্রুজের নাচের মতো বিষয়গুলো টেলর সুইফটের কনসার্ট ট্যুরকে অভূতপূর্ব করে তোলে। চলতি শতকে পপ সংস্কৃতির জগতে আর কোনো কনসার্ট এতটা প্রভাব ফেলেনি।
আমারবাঙলা/এমআরইউ