সারা দেশে শুরু হয়েছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। অপরাধীদের ধরতে এটি যৌথবাহিনীর অভিযান। তবে সংশ্লিষ্টরা জানান এর নেতৃত্বে থাকবে পুলিশ।
এদিকে এ অভিযান শুরুর পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে শুরু হয়েছে আলোচনা। অনেকেই প্রশ্ন রাখছেন- ডেভিল কারা? এই অপারেশনের আওতায় কারা পড়বে?
ইন্টারনেটে ‘ডেভিল’র সংজ্ঞা যা পাওয়া যায়, তা এক জায়গায় করলে দাঁড়ায়— এর বাংলা প্রতিশব্দ ‘শয়তান’; যা অনেক সংস্কৃতি ও ধর্মে অশুভ শক্তির প্রতীক। এটিকে একটি ‘ক্ষতিকর শক্তি’ হিসেবেই দেখা হয়। মধ্যযুগীয় ইতিহাসের মার্কিন অধ্যাপক জেফরি বার্টন রাসেল ব্যাখ্যা করেছেন, কয়েকরূপে শয়তানকে চেনা যায়; যেখানে সে ঈশ্বর থেকে পৃথক মন্দ একটি শক্তি এবং মানুষের অন্যায়ের প্রতীক।
রবিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি জানান, শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) থেকে শুরু হওয়া ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’-এ মূলত নেতৃত্ব দিচ্ছে পুলিশ বাহিনী। তাদের সাহায্য করছে সেনাবাহিনী। যারা দেশকে ‘অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে’, তাদের আটক করে আইনের আওতায় আনা এই অপারেশনের মূল লক্ষ্য।
দেশের বিভিন্ন বিভাগের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ‘ডেভিল হান্ট’ বিষয়ে তারা কী ভাবছেন, তা জানা যায়। তাদের কেউ কেউ বলছেন, যারা বেশি ‘শয়তানি করবে’ তাদের আটক করা হবে। কেউ আবার বলছেন, যে কোনো অপরাধীই ডেভিল। আর কেউ কেউ বলছেন, অপারেশন ডেভিল হান্টে দুষ্কৃতিকারী, সমাজবিরোধী, সন্ত্রাসী এবং যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিবে। তবে তাদের প্রত্যেকেই বলছেন, এ অপারেশনে সাধারণ মানুষ কোনোভাবেই হয়রানির শিকার হবেন না।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) সাবিনা ইয়াসমিন জানান, ডেভিল মানে শয়তান। যারা বেশি করে শায়তানি করবে, তাদের ধরতেই মূলত এই অভিযান।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) কমিশনার মো. জুলফিকার আলী হায়দার বলেছেন, ‘ডেভিল হলো তারা, যারা এই সোসাইটির জন্য শত্রু। যে কোনো অপরাধীই ডেভিল। যারা অপরাধী, এই সমাজের জন্য ক্ষতিকর, সোসাইটির জন্য ক্ষতিকর এবং যারা সোসাইটির জন্য স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে নষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায়; তারাই হলো ডেভিল।’
‘সুনির্দিষ্ট মামলা রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ উল্লেখ করে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার কাজী আখতারুআলম বলেন, ‘অপারেশন ডেভিল হান্টে দুষ্কৃতিকারী, সমাজবিরোধী, সন্ত্রাসী এবং যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সাধারণ মানুষ কোনোভাবেই হয়রানির শিকার হবে না। তবে এই অপারেশনে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।’
সিলেট মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, যারা চলমান শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্ন করার তৎপরতার সঙ্গে জড়িত এবং নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড ইতোমধ্যে করেছে বা করবে, তাদের ডেভিল বলা হয়। একইসঙ্গে যারা অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে, তাদের ‘ডেভিল হান্ট অপারেশনের’ আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি।
ডেভিল কীভাবে শনাক্ত করা হবে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অপরাধী যতই বড় হোক না কেন, সে আইনের চোখে অপরাধী। যারা অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের সব তথ্য পুলিশের কাছে আছে। সেইসঙ্গে অপরাধীদের সার্বিক বিষয় ও গতিবিধি নজরদারি করছে গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক টিম।
‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, ‘সমাজে যারা দুষ্ট প্রকৃতির, আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধেই এই অপারেশন ডেভিল হান্ট। এ অভিযান কোনো দল বা মতের বিরুদ্ধে নয়।’
ডেভিল কারা জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, ‘জেলায় এখনো আমরা অভিযান শুরু করিনি। অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। অভিযানে গ্রেপ্তার হলে তখন দেখবেন ডেভিল কারা।’
উল্লেখ্য, স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনি রবিবার সচিবালয়ে বলেন, এই অপারেশন যৌথভাবে সবাই মিলে একটা ফোকাসড ওয়েতে কাজ করবে। দেশকে অস্থিতিশীল করার যে চেষ্টা হচ্ছে, সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই অপারেশন চলবে। এর জন্য আইনানুগ পদ্ধতিতে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, সেটি নেওয়া হবে।
তবে উদ্দেশ্য কিংবা কার্যক্রম যেমনই হোক না কেন, এই অপারেশনের নাম নিয়েই আপত্তি তুলেছেন মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন। তিনি বলেন, ‘একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমি মনে করি, অপারেশন ডেভিল হান্ট অসম্ভব ভীতিকর এবং মানবাধিকার হরণ করার আশঙ্কা তৈরি করে— এমন একটি সামরিক ভাষা এবং অভিযান। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে আমাদের ভাষায়, আমাদের চিন্তায় চেতনায়, এমন ভীতিকর সামরিক শব্দ ব্যবহার করাটা আসলে দুঃখজনক।’
তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট থেকে এমন শব্দের ব্যবহার উচিত নয় এবং এই শব্দগুলোর উৎপত্তি কেমন করে হলো, সেটি আসলে পরিষ্কার না; কে বা কারা সেটির উৎপত্তি ঘটালো সেটিও স্পষ্ট নয়। তবে নিজেদের আশ্বাস দেওয়ার জন্য বলতে পারি, আমরা যারা শিশুতোষ ভিডিও গেম সম্পর্কে পরিচিত, তারা হয়তো জানি যে ডেভিল হান্ট নামে একটি ভিডিও গেম আছে। স্বর্গ ও নরকের সংঘর্ষের শক্তি সম্পর্কে একটি খেলা আরো আকর্ষণীয় হওয়ার যোগ্য, যদি গেম-প্লেতে না হয়, অন্তত গল্পে। ভিডিও গেমে অপারেশন ডেভিল হান্ট উভয় ফ্রন্টেই কাজ করতে ব্যর্থ হয়। এতে পরকালের একটি সুন্দর ধারণা দেয়, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আমাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যবৃন্দ তেমন একটি পরকালের সুন্দর বাংলাদেশের সম্ভাবনা দেখাচ্ছেন কি?’
তিনি এই অপারেশন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘কারা শয়তান, কারা ভালো এবং কারা অপরাধী— তা নির্ণয় করবে কে এবং কারা? নির্ণয় করার অধিকারী হলো আইন এবং আদালত। নাগরিকদের ভয় হলো, আইন ও আদালতের অনুপস্থিতিতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা না নিজেরা আইন ও আদালত হয়ে ওঠেন!’
এদিকে রবিবার রাজধানীর খামারবাড়িতে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, যারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধেই অভিযানে নেমেছেন তারা। আর যতক্ষণ না ‘ডেভিল’ শেষ হচ্ছে, ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট' ততক্ষণ চলবে।
অন্যদিকে অপারেশন ডেভিল হান্টে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৩০৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রবিবার সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর সাংবাদিকদের এই তথ্য জানিয়েছেন। শনিবার রাত থেকে রবিবার পর্যন্ত অপারেশনের তথ্য দিয়ে এআইজি জানান, এর মধ্যে দেশের সব মেট্রোপলিটন পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ২৭৪ জনকে। অন্যদিকে সারাদেশের রেঞ্জ পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে এক হাজার ৩৪ জনকে।
আমারবাঙলা/এমআরইউ