দেশে ২০২৪ সালের শেষ পাঁচ মাস- আগস্ট থেকে ডিসেম্বর এই সময়ে এক হাজার ৫৬৫ জন খুন হয়েছে। এতে প্রতি মাসে গড়ে খুন হয়েছে ৩১৩ জন। এ সময় হামলাকারীদের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্রে দেড় সহস্রাধিক মানুষ আহত হন। পুলিশ সদর দপ্তর, হাসপাতাল ও হতাহতের পরিবার সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে চলে যান। ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। পরে নানাবিধ কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে।
এদিকে চলমান ২০২৫ সালেও এই অপরাধমূলক ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। চলতি জানুয়ারি মাসের ২৫ দিনে দেশে প্রতিদিন একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে।
দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। পুলিশের সব ইউনিটপ্রধানকে এ ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অভিযান চালিয়ে অনেক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
সূত্র বলছে, চলতি মাসের গত ২৫ দিনে দেশে প্রতিদিন একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও ডাকাতি। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হলেও বেশিরভাগ অপরাধী অধরা।
সর্বশেষ গত শুক্রবার এক দিনেই তিনটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে মধ্যরাতে রাজধানীর মিরপুরের দিয়াবাড়ী সিটি বস্তিতে মো. মিলন নামের এক পোশাককর্মীকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
একই দিন রাত সাড়ে ৯টায় খুলনা নগরের তেঁতুলতলা মোড় এলাকায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অর্ণব কুমার সরকারকে প্রকাশ্যে গুলি ছুড়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
এর আগে ওই দিন দুপুরে চট্টগ্রামের রাউজানে জুমার নামাজ আদায়ে যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে জাহাঙ্গীর আলম (৫৫) নামের এক ব্যবসায়ী নিহত হন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এভাবে প্রতিদিন রাজধানী বা ঢাকার বাইরে চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় নদী, খাল-বিল, মাঠ, ঝোপ-জঙ্গল থেকে অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটছে। একই সঙ্গে চুরি-ছিনতাই, দস্যুতা ও ডাকাতির মতো অপরাধমূলক ঘটনা বেড়েছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যা ও বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনা বেড়ে যাওয়া মানে সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। তাদের মতে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর ব্যর্থতার কারণেই মূলত এসব ঘটছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করে জনমনে শান্তি ফেরাতে হবে।
হত্যার নেপথ্যের কারণ বিশ্লেষণে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, পূর্বশত্রুতা, রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, সম্পত্তির লোভ ও সম্পর্কের টানাপড়েনের মতো ঘটনার জেরে হত্যার ঘটনা বাড়ছে। এমনকি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেও কুপিয়ে হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের গত এক বছরের তথ্য বলছে, দেশে ২০২৪ সালে তিন হাজার ৪৩২ জন বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ খুন হয়েছে। এর মধ্যে পেশাজীবীর সংখ্যা বেশি। গত আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে এক হাজার ৫৬৫ জন খুন হয়। এর আগের সাত মাসে খুন হয় এক হাজার ৮৬৭ জন। এই হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে ২৬৭ জন খুন হয়।
পুলিশের অন্য এক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে দেশে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৭৯৬টি মামলা হয়েছে। আগের বছর ২০২৩ সালে একই সময়ে এই অপরাধে মামলা হয় ৪৯৪টি। একই সময়ে অপহরণের ঘটনায় ৩০২টি মামলা হয়। ২০২৩ সালের এ সময় এসব অভিযোগে মামলা হয় ১৬০টি।
পুলিশ ও আদালতের অপরাধবিষয়ক তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক মাসে রাজধানীর ৫০টি থানা এলাকায় অন্তত ৩৪ জন ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে মামলা করেছে। মেয়র হানিফ উড়ালসেতুতে গত ১৮ ডিসেম্বর কামরুল হাসান নামের একজন ছিনতাইকারীদের ধারালো অস্ত্রে খুন হন। এর আগে ১৫ ডিসেম্বর হাবিব উল্লাহ নামের একজন মগবাজার এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। আহত হয়েছেন অনেকে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে কামরাঙ্গীর চর বেড়িবাঁধ এলাকায় সজল রাজবংশী নামের এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে টাকাসহ ৭০ ভরি স্বর্ণালংকার ডাকাতির অভিযোগ পাওয়া যায়।
একই সঙ্গে চাঁদাবাজির ঘটনাও বাড়ছে। গত ১০ জানুয়ারি রাতে চাঁদা না পেয়ে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে ব্যবসায়ী এহতেশামুল হককে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে নিউ মার্কেট থানায় মামলা হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) মো. সাজ্জাত আলী বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তৎপর রয়েছে। অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই।
দেশে সাম্প্রতিক ১৫টি হত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১১টি খুনে ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। বাকি তিনটি গুলি করে হত্যা।
গত ২২ জানুয়ারি মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে রুবেল নামের এক যুবককে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল জাদুরানী বাজারের একটি বটগাছে দুই হাত বেঁধে ঝুলিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। গত ২০ জানুয়ারি রাজধানীর পল্লবীতে বাবু নামের একজনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গত ১ জানুয়ারি কিশোর-তরুণ অপরাধীরা মালপত্র ছিনিয়ে নিতে না পেরে হাসিবুল ইসলাম নামের একজনকে কুপিয়ে হত্যা করে।
আমারবাঙলা/এমআরইউ