মুজিবনগর কর্মচারী হিসেবে চাকরি পাওয়া সাব-রেজিস্ট্রার মোঃ লুৎফর রহমান মোল্লা গত ১৫ বছরে গড়ে তুলেছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে এই সম্পদ বানিয়েছেন তিনি বলে জানা গেছে। সম্প্রতি আমার বাঙলা’র অনুসন্ধানে জানা গেছে আওয়ামী সুবিধাভোগী সাব-রেজিস্টার লুৎফর রহমান মোল্লা সম্পর্কে নানান চাঞ্চল্যকর তথ্য।
জানা গেছে, ভূয়া সনদ ম্যানেজ করে ২০০৯ সালে ঢুকে পড়েন সরকারি চাকরিতে। মুজিবনগর কর্মচারী হিসেবে সাব-রেজিস্টার হিসেবে চাকরি করতে এসে ধরাকে সরা জ্ঞান শুরু করেন। চাকরির মেয়াদ অল্পদিন হওয়ার কারণে দুহাতে টাকা কামাতে শুরু করেন। স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়দের নামে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করেন সেসব টাকা। অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১৫ বছরে তিনি প্রায় ৭০ কোটি টাকা পাচার করেছেন দেশের বাইরে।
বর্তমানে ঢাকার উত্তরাতে কর্মরত সাব-রেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ছিল আগে থেকেই। আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে সেসব অভিযোগকে পাত্তা দেননি তিনি। প্রভাব খাটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় চাকরি করে গেছেন। শেষে আওয়ামী নেতাদের দখলদারিকে আইনি বৈধতা দিতে তাকে ঢাকার ধানমণ্ডিতে আনা হয় ২০১৮ সালে। ধানমণ্ডির অনেক খাস জমি এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের জমি আওয়ামী নেতাদের দখল ও বৈধকরণে ভূমিকা রাখেন লুৎফর রহমান মোল্লা। পরিবর্তে সাধারণ মানুষের হয়রানি ওঠে চরমে। আর দুহাতে অবৈধ টাকা কামাতে থাকেন তিনি।
চাকরি জীবনে অসংখ্য দুর্নীতি এবং অনিয়ম করে টাকার পাহাড় গড়েছেন লুৎফর রহমান মোল্লা। ভুয়া নামজারী দিয়ে দলিল করা, খাজনা আদায়ের রিসিট ছাড়া দলিল করা, গৃহায়নের সেল পারমিশন বহিভূর্ত ফ্ল্যাটের দলিল করা, দলিলে ফিস দাগানোর ফলে অবৈধ কাজের দ্বারা অর্জিত বিপুল অর্থ যা দ্বারা তিনি নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এমনকি সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন সাব-রেজিস্টার লুৎফর রহমান মোল্লা।
লুৎফর রহমান মোল্লার আওয়ামী যোগাযোগ এতোই শক্তিশালী ছিল যে, চাকরিবিধি অমান্য করে ধানমণ্ডি থেকে বদলীর দুই বছরের মধ্যে কিশোরগঞ্জ ও গোপালগঞ্জ হয়ে আবারো ফিরে আসেন ঢাকায়। ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর ঢাকার উত্তরায় যোগদানের পর থেকে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষকে নানান বিড়ম্বনায় ফেলে, আইনি ভীতি প্রদর্শন করে অবৈধ অর্থ উপার্জন করতে শুরু করেন।
এ ব্যাপারে দৈনিক আমার বাঙলা’র হাতে একাধিক ভুক্তভোগীর অভিযোগ এসেছে। ধানমণ্ডির মত উত্তরাতেও সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন লুৎফর রহমান মোল্লা। দালাল এবং নকল নবিসদের নিয়ে তৈরি এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রতিমাসে হাতিয়ে নেন বিপুল পরিমান টাকা।
উত্তরার বাসিন্দা এক অভিযোগকারী লুৎফর রহমান মোল্লা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘সাব-রেজিস্টার লুৎফর রহমান মোল্লার নাম নিলেও পয়সা খরচ করতে হয়। তার চারপাশ ঘিরে থাকে দালালদের সিন্ডিকেট। কয়েক দফা তাদের হেনস্তার শিকার হয়েছি আমি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লুৎফর রহমান মোল্লা ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত যত জায়গায় চাকরি করেছেন, প্রত্যেক জায়গাতেই ছিল তার সিন্ডিকেট গড়ে তোলার প্রবনতা।
তার দায়িত্বকালে জমি রেজিস্ট্রেশনের সময় রাজস্ব হিসেবে জমাকৃত পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফট ও চেক ব্যাংকের হিসেবে নির্ধারিত সময়ে জমা হয় না। এ কারণে এসব পে-অর্ডার ও চেক সংশ্লিষ্ট দফতর হতে খোয়া গেছে একাধিকবার। জালিয়াতির মাধ্যমে এ সব অর্থ আত্মসাত করেছেন তিনি। জমি রেজিস্ট্রিকালে জমাকৃত জাল পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফট কিংবা চেক নির্ধারিত সময়ে জমা না দেয়ার কারণে ধরা পড়েনি। এসব চেক ও পে-অর্ডার এন্ট্রি দেয়ার জন্য রক্ষিত রেজিস্ট্রারের সকল কলামগুলো পূরণ করা হয়নি। রেজিস্ট্রেশন ম্যানুয়েল অনুযায়ী ক্যাশ ট্রানসেকশন রিপোর্ট বা সিটিআর নিয়মিত ব্যাংকের সাথে মিলিয়ে সংরক্ষণ করার বিধান থাকলেও বাস্তবে তা সংরক্ষণ করা হয়নি। পে-অর্ডার কিংবা চেক সময়মতো রাজস্ব খাতে জমা না হলে তা সংশ্লিষ্ট ইস্যুকারী ব্যাংকে দাবিদারবিহীনভাবে পড়ে থাকে। এক সময় তা ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা আত্মসাতের সুযোগ পায়। এভাবে এই খাত থেকেও টাকার ভাগ নিয়েছেন লুৎফর রহমান মোল্লা।
এ ছাড়া বিতর্কিত জমিগুলো রেজিস্ট্রেশন করে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করার একাধিক প্রমাণ এসেছে তার বিরুদ্ধে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে আরও ভয়াবহ চিত্র। আইনের অপব্যাখ্যা দিয়ে মোটা অংকের টাকা নিয়ে সরকারি খাস জমি নিবন্ধন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ খাজনা খারিজ ব্যাতিত ভূমি নিবন্ধন করেছেন অহরহ। ফলে সরকার মোটা অংকের রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে।
সরেজিমনে অনুসন্ধনে জানা যায়, দুর্নীতিবাজ এ সাব-রেজিস্ট্রার ২০০৯ সালে মুজিবনগর সরকারের ভূয়া সনদ দাখিল করে সাব-রেজিস্ট্রার পদে গত ১৯/১২/২০০৯ইং তারিখে খুলনার তেরখাদা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যোগদান করেন। সেখানে যোগদান করেই নানা অপকর্ম করে দুহাতে কামিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। তারপর বদলী হন খুলনার অুলতলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। সেখানে খাস জমি ব্যক্তিমালিকানায় দলিল রেজিস্ট্রি করে হয়ে জান টাকার কুমির। এরপর গোপালগঞ্জের কাশিয়ানিতে বদলি হয়ে মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানীর নামে দলিল রেজিস্ট্রি করে রাতারাতি কোটিপতি বনে চলে যান তিনি।
বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলেও সেসবকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বদলী হন দেশের লোভনীয় সব সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। সাতক্ষিরা সদর, মাগুরা সদর ও কিশোরগঞ্জ সদরে চাকরির সময়ে দলিল মূল্যের ১% অগ্রিম গ্রহণ ব্যতিত দলিল করতেন না তিনি। সেরেস্তা ফি’র নামেও আদায় করেন দলিল প্রতি ২ হাজার টাকা। হেবার ঘোষনা দলিলে প্রতি শতাংশে ৩শ টাকা, বিনিময় দলিলে প্রতি শতাংশে ৫শ টাকা, হাইভেল্যুর নামে আদায় করেন ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। নকল প্রতি সাব-রেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লা নিতেন ১৫শ টাকা।
এমনও হয়েছে, জেলা রেজিস্ট্রারের অনুমতি ব্যতিত বহু দলিল কমিশনে রেজিস্ট্রি করে থাকেন তিনি। আওয়ামী প্রভাব খাটিয়ে এসব করতে তিনি। ডিআর এর নামেও বিভিন্ন খাত থেকে আদায় করে থাকেন প্রতি মাসে দেড় লাখ টাকা।
সব মিলিয়ে গত পনের বছরে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করেছেন সাব-রেজিস্টার লুৎফর রহমান মোল্লা। যার বড় একটা অংশ পাচার করেছেন দেশের বাইরে।
স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোসর এই সাব-রেজিস্টার এখনো তার অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। তাকে যেন উত্তরা থেকে বদলি করা না হয়, সে চেষ্টা চালাচ্ছেন। সম্প্রতি আইজিআর বরাবর আবেদনও করেছেন যাতে তাকে উত্তরা থেকে বদলী করা না হয়।
সাব-রেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লার দুর্নীতি অনিয়ম সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক মোঃ নূর ইসলাম বলেন, ‘অভিযুক্ত সকল সাব-রেজিস্ট্রারের ব্যাপারে তদন্ত চলছে। আমাদের একটু সময় দিন। সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
আমার বাঙলা/ আরএ