দীর্ঘ ৭৩ বছর ধরে ইফতারে রাজশাহীর বাটার মোড়ের জিলাপির স্বাদ অনন্য। ১৯৫২ সালে তমিজ উদ্দিন গড়ে তুলেন ‘রানীবাজার রেস্টুরেন্ট’। তখন হরেক স্বাদের মিষ্টির সঙ্গে ছিল জিলাপি। জিলাপির সুখ্যাতি ছড়িয়ে যাওয়ায় ১৯৭৪ সালে তমিজ উদ্দিনের ছেলে শোয়েব উদ্দিন অন্য মিষ্টি বাদ দিয়ে শুধু জিলাপির ব্যবসা শুরু করেন। তখন থেকেই রানীবাজার রেস্টুরেন্টে শুধু জিলাপি ভাজা হয়।
এরই মাঝে হারিয়ে যায় রানীবাজার রেস্টুরেন্টের নাম। স্থানের নামের সঙ্গে জিলাপির নাম মিশে এখন ঐতিহ্যবাহী ‘বাটার মোড়ের জিলাপি’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। রাজশাহীবাসীর ইফতারে বাটার মোড়ের জিলাপির জুড়ি নেই।
বাটার মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, ইফতারের আগে অধিকাংশ দোকানে কেনাকাটা প্রায় বন্ধ। একটি দোকানে ক্রেতার ভিড়। দোকানটিতে কোনো সাইনবোর্ড নেই। তেমন আসবাব বা সাজসরঞ্জামও নেই। তবু ক্রেতার ভিড় থাকে শেষ পর্যন্ত। রোজা এলেই কয়েক গুণ কদর বেড়ে যায় বাটার মোড়ের জিলাপির। ইফতার আইটেমে এই জিলাপি থাকতেই হবে।
বর্তমানে তমিজ উদ্দিনের তিন নাতি এই দোকান পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন। কথা হয় তাদের একজন শামীম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রানীবাজার রেস্টুরেন্ট নামে প্রথমে ব্যবসা শুরু হয়েছিল। তখন জিলাপির সঙ্গে হরেক স্বাদের মিষ্টিও পাওয়া যেত। কিন্তু জিলাপির সুনাম ছড়িয়ে গেল। একসঙ্গে অনেক আইটেম থাকলে মান ধরে রাখা যায় না। যেহেতু জিলাপির অনেক সুনাম, তাই ১৯৭৪ সালে সব মিষ্টি বাদ দিয়ে শুধু জিলাপি রাখা হলো। সেই থেকে বংশপরম্পরায় আমরা ব্যবসা চালিয়ে আসছি। সুনামের কারণেই আমরা জিলাপির ব্যবসা বন্ধ করিনি। এই জিলাপিতে কোনো কেমিক্যাল দেওয়া হয় না। শুধু চিনি, তেল, আটা, ময়দা, কলাইয়ের আটা দিয়ে তৈরি হয়।’
তমিজ উদ্দিনের আরেক নাতি হাসিব উদ্দিন নাঈম বলেন, ‘বাপ-দাদার ঐতিহ্যের ব্যবসা এটি। ক্রেতারাই আমাদের উৎসাহ দেন ব্যবসাটি যেন আমরা ধরে রাখি।’
জানা গেল, অন্য মাসের তুলনায় রমজানে জিলাপির চাহিদা বেড়ে যায়। সনাতন পদ্ধতিতে তৈরি এই জিলাপি এ বছর ২২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত বছরও এই জিলাপি ছিল ১৮০ টাকা কেজি। প্রতিদিন সাড়ে তিন থেকে চার মণ জিলাপি বিক্রি হয়।
বাটার মোড়ের এই দোকানের শুরুতে জিলাপির প্রধান কারিগর ছিলেন জামিনী সাহা। এর পর তার ছেলে কালী বাবু ও নাতি পরিমল এই জিলাপির কারিগর ছিলেন। বর্তমানের কারিগরের নাম সাফাত আলী। তিনি এই দোকানে কাজ করেন ৪২ বছর ধরে।
সাফাত আলী বলেন, ‘জামিনী সাহা, কালী বাবু ও পরিমলের সঙ্গে কাজ করেছি। এখন তারা নেই। আমি নিজেই প্রধান কারিগর হিসেবে জিলাপি তৈরি করি। জিলাপিতে ময়দা, চালের আটা, কলাইয়ের আটাসহ অনেক কিছু ব্যবহার হয়। আমরা যে খামির তৈরি করি, এটি সবাই করতে পারে না। এ কারণেই আমাদের জিলাপি স্পেশাল।’
সাগরপাড় এলাকার জাবেদ আলী বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে এসে বাটার মোড়ের জিলাপি খেতাম। এখন আমার বয়স ৫০ বছর। ছোটবেলায় স্কুলে এসে জিলাপি খেতে বন্ধুদের সঙ্গে চলে আসতাম।’
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বাসিন্দা কাউসার আলী বলেন, ‘১৯৭৮ সালে আমি নিউ ডিগ্রি কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়তাম। তখন থেকেই এই দোকানের জিলাপি খেতাম। গোদাগাড়ী থেকে এখনও শহরে এলে এই জিলাপি নিয়ে যাই।’
উপশহরের এক নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা আব্বাস আলী বলেন, ‘রাজশাহীর বিখ্যাত জিলাপি মানেই বাটার মোড়ের জিলাপি। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে আসতাম। এখন সন্তানদের নিয়ে আসি জিলাপি কিনতে।’
ঢাকায় থাকেন সোহরাব আলী। তিনি রোজা উপলক্ষে এসেছেন রাজশাহীতে। তিনি জানালেন, এখানে এলেই বাটার মোড়ের জিলাপি বাড়িতে নিয়ে যান।
আমারবাঙলা/এমআরইউ