মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলস্থ বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন বিগত ১৩ বছরে ৬৫৮টি বন্যপ্রাণী লোকালয় থেকে উদ্ধার করেছে। উদ্ধারের পর আহত প্রাণীকে সেবা দিয়ে সুস্থ করা এবং সুস্থদের সাথে সাথেই বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কাছে হস্তান্তর করে। তারা সেগুলোকে আবার শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া বনে ছেড়ে দিয়েছে বলে সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক সজল দেব আমার বাঙলাকে জানিয়েছেন।
তিনি জানান, গাছ কেটে লাউয়াছড়া বন উজাড় করা, বন্যপ্রাণী অবাসস্থল ধ্বংস করা, খাদ্য ও পানির সংকটসহ নানা কারণে বন্যপ্রাণীরা বন ছেড়ে লোকালয়ে এসে প্রতিনিয়ত মানুষের হাতে ধরা পড়ছে। এছাড়াও কোনো কোনো সময় গাড়ি চাপা ও মানুষের হাতেও মারা যাচ্ছে। এভাবে গত ১৩ বছরে খাদ্য, পানি ও আবাসস্থল সংকটে বন ছেড়ে লোকালয়ে আসা ৬৫৮টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে বনে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
জানা যায়, ১৯৬৫ সালে শ্রীমঙ্গল উপজেলার পশু প্রেমিক সিতেশ রঞ্জন দেব নিজ উদ্যোগে সদর ইউনিয়নের নেয়াগাঁও গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন বন্যপ্রাণী আশ্রয়কেন্দ্র। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আশ্রয়কেন্দ্রটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১৯৭২ সালে সীতেশ রঞ্জন দেব তার আর, কে মিশন রোডের বাসায় ক্ষুদ্র পরিসরে পুনরায় চালু করেন আশ্রয় কেন্দ্রটি।
পরবর্তীতে রূপসপুর গ্রামে পাঁচ বিঘা নিজস্ব জমির খামারবাড়িতে এটি স্থানান্তর করেন। সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে যার নামকরণ করেন বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বন ছেড়ে খাদ্য ও বাসস্থানের সন্ধানে লোকালয়ে আসা প্রাণীদের উদ্ধার করে নিবিড় পর্যবেক্ষণ, সেবা ও চিকিৎসা দিয়ে পুনরায় বনে ফিরিয়ে দেয়া হয়। যে প্রাণীগুলো বনের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না, বা সুস্থ নয়, এমন প্রাণীদের এখানে রেখেই পরিচর্যা করা হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনে অর্ধশতাধিক বিপন্ন ও বিরল প্রজাতির প্রাণী রয়েছে জানিয়ে ফাউন্ডেশনের পরিচালক স্বপন দেব বলেন, এখানে উল্লেখযোগ্য প্রাণীদের মধ্যে মেছো বিড়াল (যা মেছো বাঘ নামে পরিচিতি), ভাল্লুক, উল্লুক, চশমা হনুমান, গাধা, লজ্জাবতী বানর, চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, ইমু পাখি, গন্ধগোকুল, অজগর, শঙ্খিণীসহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, সাধারণ প্রজাতির বানর, ধূসর বানর, সোনালি বিড়াল, বন বিড়াল, হিমালয়ান পাম সিভিট, হনুমান, বনরুই, গুইসাপ, বন্য শূকর, উড়ন্ত কাঁঠবিড়ালি, বোম্বেটিনকেট গ্লেইক, ধনেশ পাখি, কাছিম, পেঁচা, বাজপাখি, শকুন, ময়নাসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি রয়েছে।
এ বিষয়ে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) জামিল মোহাম্মদ খাঁন বলেন, ‘বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন থেকে অক্ষত অবস্থায় যেসব প্রাণী আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল সেসব জীবিত বন্য প্রাণীকে লাউয়াছড়া বনে অবমুক্ত করেছি এবং মৃত প্রাণীকে মাটি চাপা দেয়া হয়।’
সেবা ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন দিবসে বিভিন্ন দিনে বন বিভাগ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বন্যপ্রাণীগুলোকে বনে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পরিস্যাংখানে মতে ২০১২ সাল থেকে ২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারী পর্যন্ত ৬৫৮টি বন্যপ্রাণী বনে অবমুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- অজগর সাপ ১৩১ টি, লজ্জাবতী বানর ৪০টি, গন্ধগোকুল ৪৬টি, মেছো বিড়াল ৩৩ টি, বানর ২৭ টি, তক্ষক ১৭ টি, সোনালী বিড়াল ৫ টি, বনবিড়াল ৪৫ টি, হিমালয়ান পাম সিভেট ১ টি, কালনাগিন সাপ ৪ টি, হনুমান ১ টি, বনরুই ১ টি, গুইসাপ ৪ টি, বন্য শুকর ৩টি, উড়ন্ত কাঠবিড়ালী ৫ টি, লেজহীন চিকা ১ টি, বোম্বেটিনকেট স্নেক ১ টি, ধনেশ পাখি ১ টি, কাছিম ৩ টি, পেঁচা ১৮টি,সবুজ বুড়াল সাপ ১৪ টি, শঙ্খিনী সাপ ১২টি, ফনিমনসা সাপ ৮ টি, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ১৩৯ টি, শিয়াল ১ টি ,পদ্মগোখরা সাপ ৩ টি, হিমালয়ান ধূরা সাপ ৫১ টি, দুধরাজ সাপ ২ টি, দাঁড়াশ সাপ ৭ টি, সবুজ বুড়াল সাপ (পিট ভাইপার সাপ) ৬ টি, বাজপাখি ২ টি, খইয়া গোখরা সাপ ২ টি, সবুজ ফনিমনসা সাপ ৩ টি, কোবরা (কালা খরিস) সাপ ১ টি, বিরল লালডোর সাপ ১ টি, আইডক্যাট স্নেক ৫ টি, কালো বক ১ টি, নিশি বক ১ টি, রেসাস বানর ১ টি, ঘর গিন্নি সাপ ৩ টি, গ্রে কেট স্নেক ১ টি, ক্যান্টরের (কুকরি সাপ) ১ টি, মেটে সাপ ১ টি বনে অবমুক্ত করা হয়েছে।
আমারবাঙলা/ইউকে