রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে দিন দিন তামাক চাষের বিস্তার বাড়ছে। অধিক মুনাফার আশায় কৃষকরা এই ক্ষতিকর তামাক চাষে ঝুঁকছেন, ফলে প্রতি বছর নতুন নতুন ফসলি জমি তামাক চাষে যুক্ত হচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানির আর্থিক সহায়তা ও প্রলোভনে কৃষকরা দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যঝুঁকি সত্ত্বেও এই চাষ চালিয়ে যাচ্ছেন।
তামাক চাষে ব্যবহৃত বিভিন্ন ক্ষতিকর সার ও রাসায়নিক পদার্থের কারণে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে এবং কৃষকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে চলেছে। গোয়ালন্দ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার একটি পৌরসভা ও চারটি ইউনিয়নে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ হেক্টর, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩ হেক্টর এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। এর মধ্যে উজানচর ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। এছাড়া উপজেলার দুর্গম এলাকাগুলোতেও কৃষকরা তামাক চাষে ঝুঁকছেন।
জানা গেছে, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেড, জাপান টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেড, আবুল খায়ের টোব্যাকো কোম্পানিসহ বিভিন্ন বিড়ি, সিগারেট ও জর্দা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব প্রতিনিধির মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে। সরকারি তদারকির অভাবের কারণে কৃষকরা সহজেই এসব কোম্পানির প্রলোভনে পড়ে তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।
স্থানীয় তামাক চাষি আলেব খাঁ বলেন, "জমিতে খাদ্যশস্য রোপণ করে লাভবান হতে পারিনি। তাই ক্ষতিকর জেনেও লোকসান এড়াতে বাধ্য হয়েই তামাক চাষ করছি। "আরেক চাষি সুলতান বলেন, "কোম্পানি আমাদের বীজ, সার, কীটনাশক, ত্রিপল ও উৎপাদনের যাবতীয় সামগ্রী সরবরাহ করে। পরে তারাই তামাক পাতা কিনে নেয়। এতে আমাদের বিনিয়োগ কম, কিন্তু লাভ বেশি। "একই এলাকার চাষি ওহিদ প্রামাণিক জানান, "তামাক চাষে অন্যান্য ফসলের তুলনায় দ্বিগুণ লাভ হয়। তবে শরীর ও পরিবেশের ক্ষতি হয়, এটা বুঝতে পারি। কিন্তু সংসার চালাতে লাভের দিকটাই দেখতে হয়।"
তামাক চাষে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ফলে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে এবং আশপাশের এলাকার পরিবেশও দূষিত হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, তামাক চাষের ফলে কৃষকদের ক্যান্সার, পেটের পীড়া, ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা, চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ছে।
গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. শরিফ ইসলাম বলেন, "দীর্ঘদিন তামাক চাষে যুক্ত থাকলে শরীরে নিউরো-টক্সিক প্রভাব পড়ে। এছাড়া অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD), ক্যান্সার (বিশেষত ফুসফুস, অগ্ন্যাশয়, ল্যারিংস ও মুখগহ্বরের ক্যান্সার) এবং উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। তাই তামাক চাষ রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ জরুরি।"
গোয়ালন্দ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. খোকন উজ্জামান জানান, "তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে কৃষকদের সচেতন করতে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমাদের কৃষি উপসহকারীরা নিয়মিত কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে কাজ করছেন।"
পরিবেশবিদরা বলছেন, তামাক চাষের নেতিবাচক প্রভাব রোধে গণসচেতনতা বৃদ্ধি এবং তামাকজাত পণ্যের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করা প্রয়োজন। তামাক চাষ থেকে কৃষকদের বের করে আনার উপায়। স্থানীয় কৃষকরা মনে করেন, তামাকের বিকল্প লাভজনক ফসলের প্রচার ও সহায়তা দেওয়া হলে তারা ধীরে ধীরে তামাক চাষ থেকে সরে আসতে পারবেন।
তামাক চাষ গোয়ালন্দের কৃষি, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য এক বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই যথাযথ তদারকি, সরকারি উদ্যোগ, বিকল্প চাষের সুযোগ তৈরি এবং কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
আমারবাঙলা/ইউকে