চিকিৎসক সঙ্কটে চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলা ৫০ শয্যা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসাসেবা।
হাসপাতালে মোট চিকিৎসকের ২৬টি পদের মধ্যে ২২টি পদই দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। ৪ চিকিৎসকের মধ্যে ৩ জন মেডিকেল অফিসার ও একজন সহকারী ডেন্টাল সার্জন রয়েছেন। বর্তমানে ডেন্টাল চিকিৎসক বাদে হাসপাতালের জরুরী বিভাগ, বহিঃবিভাগ ও আন্তঃবিভাগে চিকিৎসা দিচ্ছেন মাত্র ৩জন চিকিৎসক। ফলে এ উপজেলার ২ লক্ষাধিক মানুষের স্বাস্থ্য সেবায় এখন ভরসা মাত্র ৩ চিকিৎসক। এতে রোগীদের চাপে চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে রোগী ও তাদের স্বজনরাও পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে। বেশিরভাগ রোগী এ হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে বাধ্য হয়ে যাচ্ছেন জয়পুরহাট জেনারেল হাসপাতাল, নওগাঁ ও বগুড়া মেডিকেল সহ বিভিন্ন ক্লিনিকে।জানা গেছে, ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলা ৩১ শয্যা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ২০০৪ সালে হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নত হয়।
আক্কেলপুর উপজেলায় দুই লক্ষাধিক মানুষের একমাত্র ভরসা এই হাসপাতালটি। পাশাপাশি পাশ্ববর্তী নওগাঁর বদলগাছী উপজেলা থেকেও মানুষ এখানে আসেন সেবা নিতে। এখানে শুধুমাত্র বহিঃবিভাগেই প্রতিদিন চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন ৪শত থেকে ৫শত মানুষ। এছাড়া ৫০ শয্যার হাসপাতালে ভর্তি থাকে প্রায় দিগুন রোগী। এ হাসপাতালে কাগজে কলমে ২৬ জন চিকিৎসক থাকার কথা।
কিন্তু এর বিপরীতে বর্তমানে রয়েছে মাত্র ৪ জন। জুনিয়র কনসালটেন্ট ১১টি পদ থাকলেও সব গুলো রয়েছে ফাঁকা। এছাড়া মেডিকেল অফিসার/সহকারী সার্জন ১৪ জন থাকার কথা থাকলেও রয়েছে মাত্র ৩ জন। এছাড়া সহকারী ডেন্টাল সার্জন রয়েছেন একজন। স্ত্রীরোগ, সার্জারি বিশেষজ্ঞ ও অবেদনবিদ না থাকায় অস্ত্রোপচারের কক্ষ থাকলেও এখানে দীর্ঘদিন ধরে প্রসূতি অস্ত্রোপচার সহ সব ধরনের অস্ত্রোপচার বন্ধ রয়েছে। এতে অস্ত্রোপচারের জন্য চিকিৎসা সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে জুনিয়র কনসালটেন্টের মেডিসিন, সার্জারি, স্ত্রীরোগ, শিশু, অর্থোপেডিকস, নাক-কান-গলা, চর্ম ও যৌন, চক্ষু, অ্যানেসথেসিয়া, ফিজিক্যাল মেডিসিন ও হৃদরোগ পদ খালি থাকায় এসব সেবা পাচ্ছেননা রোগীরা। এতে মহাবিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বাধ্য হয়ে অনেকেই জয়পুরহাট জেনারেল হাসপাতাল, বগুড়া ও নওগাঁয় যাচ্ছেন।
নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার গোবরচাপা থেকে মেয়েকে এ হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন মাসুদ রানা। তিনি বলেন, আমার মেয়েকে আক্কেলপুর হাসপাতালে চর্ম বিষয়ক ডাক্তার দেখানোর জন্য এসেছিলাম। কিন্তু এসে শুনলাম এই ধরনের ডাক্তার এখানে নেই। এখন জয়পুরহাট জেনারেল হাসপাতালে যাব, না হয় নওগাঁতে যাবো। এখানে ডাক্তার থাকলে সুবিধা হতো। এখন সময় নষ্ট করে অন্য জায়গায় যেতে হবে। আক্কেলপুর পৌর শহরের বিহারপুর এলাকার কোরবান আলী বলেন, এই হাসপাতালে সবকিছুর সরঞ্জাম আছে। কিন্তু ডাক্তার না থাকার কারণে দীর্ঘদিন থেকে কোন অস্ত্রোপচার হয়না। আমরা চাই এই হাসপাতালে শুন্য পদগুলোতে ডাক্তার নিয়োগ করা হোক।
উপজেলার খাদাইল গ্রামের শাহজাহান আলী বলেন, আমি কয়েকদিন আগে এখানে ভর্তি হয়েছি। একজন ডাক্তার দিনে একবার দেখে গেলে সারাদিন আর কোন ডাক্তার আসেনা। ২৪ ঘন্টা পর একবার আসে। এজন্য এখানে আরও ডাক্তার দেওয়া প্রয়োজন।
জরুরী বিভাগে চিকিৎসা দেওয়ার সময় কথা হয় দায়িত্বরত ডাক্তার (আবাসিক মেডিকেল অফিসার) এর সাথে। তিনি বলেন, হাসপাতালে আমরা তিনজন চিকিৎসক হাসপাতালের বহিঃবিভাগ, আন্তবিভাগ ও জরুরী বিভাগে সকল সেবা দিয়ে যাচ্ছি। হাসপাতাল ২৪ ঘন্টার সেবামুলক একটি প্রতিষ্ঠান। শুধুমাত্র সকালে ডাক্তার থাকলে হয়না, বিকেলে থাকতে হয়, রাতে থাকতে হয়। বিগত সময়ে এই হাসপাতালে মানুষ ভাল চিকিৎসাসেবা পেলেও এখন চিকিৎসক সঙ্কটের কারণে কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেন না। তিনি আরও বলেন, আমরা এতোটাই মানষিক ও শারিরীক চাপ অনুভব করি সব সময়, যেন আমরাই যেকোন সময় অসুস্থ হয়ে যাব। আমাকে সকাল, বিকেল ও রাতেও দায়িত্ব পালন করতে হয়। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে বারবার জানানোর পরও চিকিৎসক সঙ্কট সমাধান হচ্ছে না। ২৪ জনের কাজ তো ৩ জনকে দিয়ে সম্ভব নয়। তবুও আমরা আমাদের সাধ্যমতো রোগীদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
এ ব্যাপারে আক্কেলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আবু শফি মাহমুদ বলেন, ৩ জন মেডিকেল অফিসারকে নিয়ে আমরা স্বাস্থ্যসেবা চালিয়ে যাচ্ছি। চিকিৎসক কম থাকায় সেবা দিতে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। বহিঃবিভাগে প্রতিদিন ৪শর মতো রোগী আসে। এজন্য অনেক সময় মেডিকেল এসিসট্যান্ট বা সিএমও দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা ধরে রাখতে হচ্ছে। আমিও রোগী দেখি। তিনি বলেন, ১১ বছর এ হাসপাতালে কোন সিজারিয়ান ছিল না। গত বছরের জুলাই মাসে একজন সিজারিয়ান চিকিৎসক এখানে যোগদান করেছিলেন। তিনিও কয়েক সপ্তাহ আগে বদলী হয়ে গেছেন। এজন্য সিজারিয়ান অপাশেন করা সম্ভব হচ্ছেনা। এছাড়া জুনিয়র কনসালটেন্ট না থাকায় সকল ধরনের অস্ত্রোপচার বর্তমান বন্ধ আছে। গত মাসে চিকিৎসক সঙ্কট নিয়ে আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা-পরিচালকে দুইটি চিঠি পাঠিয়েছিলাম। এরপরও কোন মেসেজ পাইনি। চিকিৎসক সঙ্কট দুর হলে এখানে রোগীরা ভাল সেবা পাবে।
আমারবাঙলা/ইউকে