মৌসুমের প্রথম আলু তোলা উপলক্ষে রাজশাহীর তানোর উপজেলার চোরখৈর গ্রামে নবান্ন উৎসবের মতো করে রবিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) রাতে অন্যরকম এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন চাষি রানা চৌধুরী।
প্রথম দিন এই কৃষকের জমি থেকে শ্রমিকেরা ৪০০ বস্তা আলু তুলেছেন। সেই আলু বস্তায় ভরে ট্রাকে বোঝাই করা হয়েছে। সারা দিনের এই পরিশ্রম শেষে অনুষ্ঠান চলে রাত ১২টা পর্যন্ত।
রানা চৌধুরী এবার ২৪ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছেন। এর মধ্যে ১০ বিঘা পৈতৃক জমি এবং বাকি ১৪ বিঘা জমি ইজারা নেওয়া। প্রতি বিঘা জমির ইজারামূল্য ২০ হাজার টাকা। তার জমিতে আলুর মৌসুমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাজ করেন ৫০ জন শ্রমিক। তাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য তিনি এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন।
সরেজমিন দেখা যায়, সারা দিন আলু তোলা হয়েছে। সন্ধ্যায় শুরু হয়েছে রান্না। আলু ও মাছের ঘন্ট। যে শ্রমিকেরা সারা দিন আলু তুলেছেন, তারাই বাজার করেছেন, তারাই রান্না করছেন। তারাই অনুষ্ঠানের অতিথি।
বিকেলে মাঠে গিয়ে দেখা যায়, লাঙল দিয়ে আলুখেতে চাষ দেওয়া হয়েছে। সারি সারি আলু দেখতে অনেকটা ডিমের মতো লাগছে। আলুর মাঠে উৎসব উৎসব ভাব। সেই শ্রমিকেরাই রাতে আবার উৎসবের আয়োজন করেছেন। গ্রামের শেষ মাথায় যেখানে রানার খামারের শুরু হয়েছে, সেখানেই একটি বাড়িতে এ আয়োজন করা হয়েছে।
সন্ধ্যার পর ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কেউ আলু আর মাছের ঘন্ট রান্না করছেন, কেউ ভাত রান্নায় ব্যস্ত। আবার কেউ হাঁসের মাংস রান্না করছেন। শ্রমিকদের খেতে বসার জন্য পেতে রাখা হয়েছে খালি আলুর বস্তা। ৭৫ কেজি আলু ধরে, এমন বস্তা কৃষক মিল থেকে বায়না দিয়ে তৈরি করে নিয়েছেন। খালি বস্তায় বসে খাওয়ার জন্য কলাপাতা ও কিছু ওয়ান টাইম প্লেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেকে কলাপাতায় খাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ওয়ান টাইম প্লেটে খাচ্ছেন।
এ আয়োজনের জন্য বাজার করেছেন হাফিজুল ইসলাম নামের এক শ্রমিক। তিনি বলেন, ‘আলুর ঘন্ট পাকানির লাইগি আমি নিজে কলমা হাট থাইকি ছয় কেজি কাতলা মাছ কিনে আনিছি।’
ঘন্ট রান্নার জন্য সুনাম আছে শ্রমিক এমদাদুল হকের। রাতে দেখা গেল, তার নেতৃত্বেই এই ঘন্ট রান্নার কাজ চলছে। তিনি বলেন, সাত কেজি আলু আর ছয় কেজি মাছ একসঙ্গে করে রান্না করা হচ্ছে। মাছ আর আলু প্রায় সমান সমান করা হয়েছে। এতে স্বাদ ভালো হয়।
অনুষ্ঠান আলু নিয়ে হলেও তানোরের ওই এলাকায় হাঁসের মাংস দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করার চল আছে। রানা চৌধুরী তাই শ্রমিকদের জন্য হাঁসের মাংস রান্না করার ব্যবস্থা করেন। সাইফুল ইসলাম নামের এক শ্রমিক হাঁসের মাংস রান্না করেন।
রানা চৌধুরী বলেন, এই ৫০ জন শ্রমিক আলু রোপণের শুরু থেকেই আমার মাঠে কাজ করেছেন। আমি সব সময়ই আলুর এই সুখ-দুঃখ শ্রমিকদের সঙ্গে ভাগ করে নেই। তাই খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করেছি। তিনি বলেন, নিজের ১০ বিঘা জমির হয়তো উৎপাদন খরচ উঠবে, বাকি ১৪ বিঘা জমির শুধু ইজারামূল্য শোধ হবে। আর সব খরচ পকেট থেকে যাবে। এবার আলু সংরক্ষণ খরচও কেজিপ্রতি দ্বিগুণ হয়েছে। গত বছর এক কেজি আলু চার টাকায় হিমাগারে রাখা গেছে। এবার সেই আলু আট টাকা কেজিতে রাখতে হবে। চাষিদের চারদিক থেকেই মরণ।
রাজশাহী জেলা মার্কেটিং অফিসার মনোয়ার হোসেন বলেন, কৃষকের এবার উৎপাদন খরচ গতবারের চেয়ে বেড়ে গেছে। গত বছর এক বিঘা আলু উৎপাদনে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়েছে। এবার সেই খরচ বেড়ে ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছে।
কৃষি বিভাগের হিসাবমতে, এক কেজি আলু উৎপাদন করতে কৃষকের ২১ থেকে ২২ টাকা খরচ পড়েছে। সেই আলু রবিবার ১২ থেকে ১৩ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। সোমবার ১৪ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
এদিকে আলুর উৎসব রাত ১২টায় শেষ হয়েছে। রানা চৌধুরী, তার স্ত্রী ইভা খাতুনসহ পরিবারের লোকজন হাসিমুখেই কৃষকদের সঙ্গে সময়টি কাটালেন।
আমারবাঙলা/এমআরইউ